তাইওয়ানকে চীনের আক্রমণের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়নি: জেনারেল মার্ক মিলি

তাইওয়ানকে চীনের আক্রমণের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়নি: জেনারেল মার্ক মিলি

মুশফিকুল ফজল আনসারী

তাইওয়ান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অবস্থানের সমালোচনা প্রসঙ্গে দেশটির জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি বলেছেন, “এখানে কেউ একজন জিতে যাবে আরেকজন হেরে যাবে... বিষয়টা এরকম নয়। বিষয়টা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের না। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও অনেক মিত্র আর অংশীদার রয়েছে যারা তাইওয়ানের পাশে এসে দাঁড়াবে। আর তাইয়াওয়াকে চীনের আক্রমনের জন্য ছেড়ে দেয়া হয়নি।”

শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল প্রেসক্লাবে ‘হেডলাইনারস লাঞ্চ’ অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে এই মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রধান।

তাইওয়ানকে একীভূত করতে চীনের শক্তি প্রয়োগ বন্ধ করার সুযোগ এখনো রয়েছে বলে মন্তব্য করেন জেনারেল মিলি। তিনি বলেন, “যদিও তাইওয়ানকে ২০২৭ সালের মধ্যে দখল করে নিতে প্রস্তুত থাকার জন্য চীনের সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকার খবর প্রচার করা হচ্ছে কিন্তু দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিংবা অন্য কিছু পরিকল্পনা করেছেন তার কোনো ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছেনা।”

মার্ক মিলি বলেন, “এই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়টুকুতে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য দেশগুলোকে চীনকে একটা বার্তা দেবার সুযোগ পাচ্ছে। আর সে বার্তাটা হলো- শি জিনপিং বল প্রয়োগ করতে চাইলে সেটা হবে মারাত্নক ভুল  পরিকল্পনা।”

নিজের বক্তব্য আরও স্পষ্ট করে যুক্তরাষ্ট্রের এই জেনারেল বলেন, “প্রতিটি দিন আপনাদেরকে একটা বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। আর তা হবে এমন- শি জিনপিং ঘুম থেকে উঠে ভাববেন “আজ সেই দিন নয় (তাইওয়ানে হামলা করা)।” আর সেই সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ যেনো কখনো না আসে।”

মার্ক মিলি বলেন, “যতদিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা চীনের মোকাবিলায় তাদের সমর শক্তির এগিয়ে থাকার তফাতটুকু ধরে রাখতে পারবে এবং যে জায়গায় পরিবর্তন এবং আধুনিকায়ন প্রয়োজন তা বজায় রাখে তাহলে বেইজিং তাদের সেনাদের তাইওয়ান প্রণালীতে নিজেদের সীমানা বরাবর থামিয়ে রাখবে।”

তিনি বলেন, “যত দ্রুত আমরা পদক্ষেপ নিতে পারবো তত বেশী সমর শক্তিতে এগিয়ে থাকতে পারবো। এরকম পদক্ষেপ নেবার পর যেটা হবে বলে আমি মনে করি তা হলো- যুদ্ধ থামানো যাবে। আর যুদ্ধ যদি বেধেই যায় তবে নিজেদের উপস্থিতির জানান দেয়া যাবে।”

‘ইন্টারন্যাশনাল রুলস বেইজড অর্ডার’ এবং ‘দ্য স্ট্র্যাটেজি অফ ডিটারেন্স’-এর সমালোচনা করে এই শীর্ষ জেনারেল বলেন, এগুলো বিশেষভাবে বানানো কোনো নীতি নয়। তবে যেসব চিন্তার মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হয় সেগুলো খুবই মূল্যবান।

তিনি বলেন, “প্যারাট্রুপারসদের প্রজন্মটা চেয়েছিলো 'ইন্টারন্যাশনাল রুলস বেইজড অর্ডার'-বাস্তবায়ন করার মাধ্যম পরাশক্তিগুলোর মধ্যে যেন আর কোনো যুদ্ধ না বাধে সেটা নিশ্চিত করতে। ১ম এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন লোক নিহত হয়েছে।”

মার্ক মিলি বলেন, “ইতিহাসে ঐ তিনটি দশক ছিলো সবচাইতে সংঘাতময়। পরাশক্তিগুলো তাদের ক্ষমতা দেখানোর যুদ্ধ শুরু করেছিলো।”

তিনি বলেন, “দুটি বিশ্ব যুদ্ধ হয়েছে, ৩০ টি বছর শেষ হলো, দুটি মহাদেশ ধ্বংস হলো, কোটি কোটি মানুষ প্রাণ হারালো, ইতিহাসের যেকোনো সময়ের চাইতে বেশী মানুষ শরণার্থী হয়েছিলো, পরিকল্পিতভাবে নৃ-গোষ্ঠী এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়কেনির্মূলে গণহত্যা চালানো হলো। দুটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের কথাতো বলতেই হবে। পুরো বিশ্বটা যেন কসাইখানায় পরিণত হয়েছিলো। ১৯৪৫ সালে পুরো বিশ্ব সম্প্রদায় যে কথাটা বলেছিলো তা হলো- আর নয়।”

তিনি বলেন, “এই ফ্রেমওয়ার্কের (ইন্টারন্যাশনাল রুলস বেইজড অর্ডার) মাধ্যমে প্রায় ৮০ বছর শান্তি বিরাজ করছিলো। কিন্তু এটা এখন চাপের মুখে।”

রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন প্রসঙ্গে মিলি বলেন, “কোনো উসকানি ছাড়া ইউক্রেনে রাশিয়ার এই অবৈধ আগ্রাসন ইন্টারন্যাশনাল রুলস বেইজড অর্ডার-এর ওপর সরাসরি একটা আঘাত বলা যায়।”

তিনি বলেন, “এই আগ্রাসনের এক বছরের বেশী সময় পেরিয়ে গেছে। ইউক্রেনের মানুষদের সাহস আর সহনশীলতা আমাদের সবার জন্য অনুপ্রেরণার বিষয়।”

পৃথিবীর অনেক দেশ ইউক্রেনের সমর্থনে দাঁড়িয়েছে এবং দেশ রক্ষার জন্য তাদেরকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিচ্ছে উল্লেখ করে মিলি বলেন, “আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বলেছেন ইউক্রেন যেন স্বাধীন থাকে সেটা নিশ্চিতে তাদেরকে সহয়োগিতা করতে হবে।”

তিনি বলেন, “আমরা এই সমর্থনটা দিয়ে যাচ্ছি যাতে করে 'ইন্টারন্যাশনাল রুলস বেইজড অর্ডার' নীতি ঠিক থাকে।”
মিলি বলেন, “চীন এই নীতিগুলোর সবচাইতে বেশী সুবিধাভোগী হবার পরও তারা এই নীতিগুলো পুরো বিশ্বে পাল্টে দিতে চাচ্ছে।”

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রধান বলেন, “বিগত চার দশকে চীনের অর্থনীতির দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। তারা এই অর্থনৈতিক শক্তিকে সামরিক খাতকে শক্তিশালী করার কাজে ব্যয় করছে। এই কাজে তারা খুবি ভালো।”

তিনি বলেন, “চীনের নেতারা বলছেন আগামী ১০ বছরের মধ্যে তাদের দেশটি এশিয়া অঞ্চলের শক্তিশালী দেশ হবে এবং অর্ধ শতকের মাঝে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তিকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। এই শতকের ভূ-রাজনীতির ইতিহাসে প্রভাব বিস্তারে ভূমিকা রাখতে পারে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক। সেটা প্রতিযোগিতা কিংবা বৃহৎ শক্তির যুদ্ধেও গড়াতে পারে।”

অবসরের পর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন কীনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে মিলি বলেন, “অবশ্যই না।”
তিনি বলেন, “আমি দেশ সেবা করতে চাইলে অবসরের পর এর অনেক রকমের সুযোগ রয়েছে। তবে সরকারে যোগ দিয়ে এ সুযোগের কথা ভাবছিনা।”

ক্ষমতা ধরে রাখতে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা প্রত্যাশা করলেও জেনারেল মিলির বিচক্ষণতার মুখে হালে পানি পাননি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সেসময় চৌকস এই সেনা কমান্ডারের বক্তব্য ছিলো দ্যর্থহীন। বলেছিলেন, “আমরা কোনো রাজা, রাণী কিংবা কর্তৃত্ববাদী শাসকের নামে শপথ গ্রহণ করিনা। আমাদের শপথ পবিত্র সংবিধানের নামে।”

উল্লেখ্য, ১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন মিলি। যোগদানের পর থেকে আর্মি চিফস অব স্টাফ, ইউএস আর্ম ফোর্সেস কমান্ড, থ্রী কর্পস, ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাসিস্টেন্স ফোর্স এবং টেনথ মাউন্টেইন ডিবিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে দেশটির প্রায় সব আইন প্রণেতা সর্বসম্মতিক্রমে মার্ক মিলিকে জয়েন্ট চিফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ চুড়ান্ত করেন। চলতি বছর মে মাসে বিমান বাহিনীর জেনারেল চালর্স কিউ ব্রাউন জুনিয়রকে মিলির পরবর্তী উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আগামী সেপ্টেম্বরে জেনারেল মিলি অবসরে গেলে তিনি তার স্থলাভিষিক্ত হবেন।

এনআর/