আমজনতার মঞ্চ

আমজনতার মঞ্চ

মিনা ফারাহ


বক্তৃতা শুনে বোঝার উপায় নেই, কোন দেশের প্রাইমিনিস্টার গণভবনে! ইদানিং তার শাড়িতে ভারতীয় পতাকার ছাপ নিয়ে স্যোসাল মিডিয়ায় তুমুল বিতর্ক। বক্তৃতা শুনলে কখনো মনে হয় তিনি একাই একসঙ্গে আমেরিকা এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। আওয়ামী লীগ অবশ্য তাকে বিশ্বনেত্রীর মার্যদা দিয়ে দিয়েছে, সুতরাং আমাদের প্রতিবাদের অধিকার না থাকাটাই স্বাভাবিক। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের চুক্তি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা শুনলে মনে হয়, তিনি একাই শতবর্ষ ধরে অর্থনীতিতে নোবেলপ্রাপ্ত। প্রতি সেপ্টেম্বরেই মনে হয়, তিনি সাধারণ পরিষদের সভা থেকে লোহিত সাগর, কোটি কোটি বুদ্ধিজীবিদের ইনচার্জ। খালেদার লেজ ধরে টানাটানির সময় মনে হয় তিনি একই সঙ্গে মহাত্মা গান্ধি, দালাইলামা এবং আব্রাহাম লিংকন, যদিও নিজেই বহু মানুষ পুড়িয়ে শরীর জুড়ে মানুষ পোড়ার দুর্গন্ধ ১২ হাজার মাইল দূর থেকে টের পাচ্ছি। ২০ দলকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করার পরেও শান্তির বাণী শুনলে মনে হয়, যেন তিনি একাই মেন্ডেলা, কেনেডি আর চার্চিল। সামাজিক গণতন্ত্রের খুদবা শুনলে মনে হয়, তিনিই একাই ধারণ করছেন ক্যাষ্ট্রো আর কিম জং উনের সমাজতন্ত্রকে। যখন শ্রমিকদের পক্ষে টেলিভিশনে জাতিয় ভাষণ দেন, মনে হয় একাই তিনি আইএলও প্রেসিডেন্ট, আবার শ্রমিক নেতাও। যখন পুঁজিবাজারের চোর-ডাকাতদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তখন মনে হয় তিনিই সেরা অর্থনীতিবিদ, মুখের কথায় পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়ায়, আবার পড়ে, আবার তার কথামত দাঁড়িয়ে যায়, আবার পড়ে, আবার দাঁড়ায়...। সংসদে যখন ঘন্টার পর ঘন্টা বক্তব্য রাখেন (মিনিটে খর্চ ১ লক্ষ ১১ হাজার টাকা), মনে হবে, ব্রিটেনের গণতন্ত্রও ফেল ১০ম সংসদের কাছে। আবার যখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বক্তব্য রাখেন, মনে হয় তিনিই চে গুয়োভারা, মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিপ্লবে, সামনে থেকে, সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান এবং কর্ণেল আবু তাহের নামক গেরিলাদেরকে। বকবক শুনলে মনে হয়, হো চি মিন এবং চে গুয়েভারা দুটোই তিনি, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের নেতা, পরিবার-পরিজন হারানো কোন বীরাঙ্গনা অথবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। যখন জাতিকে দায়মুক্তির শৃংখলে শৃংখলিত করার পরেও হাটেঘাটে গণতন্ত্রের বাণী শোনাতে লক্ষ লক্ষ লোক ভাড়া করেন, উক্ত বক্তৃতায় যেন তিনিই জর্জ জেফারসন আর জেমসমেডিসন। সংবিধান নিয়ে বক্তব্য শুনলে মনে হয়, মার্কিন সংবিধানের চেয়েও হাজার গুণে শ্রেষ্ঠ এই সংবিধান। আমার এই বক্তব্যের সঙ্গে যারাই দ্বিমত, যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেন, আমি ভুল।


মাহাথিরকে নিয়ে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ প্রকাশে অনেক পাঠকই ক্ষুব্ধ। সকলেই যদি হাসিনার মতো আচরণ করে, তাহলে ক্ষয়রোগে বাংলাদেশ আক্রান্ত দেশটাকে বাঁচিয়ে রাখবে কারা? মূলত আমি ডিগ্রি ছাড়াই একজন অর্থনীতির মানুষ। নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেইঞ্জ এবং রিয়েল এস্টেট ব্যবসা করে যতো না অর্থ আয় করেছি তারচেয়ে লক্ষগুণ বেশি অভিজ্ঞতা অর্জন অব্যাহত রেখেছি ৩০ বছর। সুতরাং মাহাথির সম্পর্কে যা বলেছি, ঠিক বলেছি। আপনাদের হয়তো মনে নেই, ক্ষয়রোগের শুরুতে, মাহাথিরকে দুইবার আমন্ত্রণ করে গণভবনে আনার মাধ্যমেই ভিশন্ ২০২১ ও ২০৪১ জন্ম। দেশকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বানানোর স্বপ্ন দেখানো। পারলে আমেরিকাই বানিয়ে ফেলে এবং তা আজ রাতেই। এমনকি খালেদার সঙ্গে দেখা করার মতো সৎসাহস ছিলো না মাহাথিরের। কেন? তিনি যেমন বিরোধিদলের হাতে হাতকড়া পড়িয়ে দীর্ঘ ২২ বছর ক্ষমতা ভোগ করেছিলেন, হাসিনাকেও সেই পরামর্শই দিয়ে এমন পাগল বানিয়ে দিলেন যে, এখন উল্টা অর্থনীতির কবলে পড়ে গণতন্ত্র এবং অর্থনীতি দুটোই ধ্বংসের পথে। “মালয়েশিয়া পারে” তথ্যটি কিভাবে “বাংলাদেশও পারে”-এ রূপান্তরিত হলো, মাহাথিরকেই জিজ্ঞেস করুন।
উল্টা অর্থনীতি কি? কেউ যখন ঋণ করে ঘি খায়। কেউ যখন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা খুলে শুধুমাত্র বিনিয়োগকারিদের টাকায়, অর্থাৎ নিজের অংশীদারিত্বের মুরোদ ছাড়াই। বিদেশি অর্থনীতির সঙ্গে জড়ানো আমার একদিনের অভিজ্ঞতা নয়। সুতরাং বাংলাদেশের উল্টা অর্থনীতি বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স এবং বুদ্ধি হয়েছে। আমাদের অর্থনীতিবিদরা ৯৯ ভাগই চাটুকার। আর ইউনুষের মতো অর্থনীতিবিদরা শান্তিতে নোবেল পাওয়ার পরেই বিদেশে দই বিক্রির ফমূলা ফেউরি দারুণ ব্যস্থ।

বাংলাদেশ যে ঋণ করে ভারত, রাশিয়া, চীন, জাপান থেকে কতো ঘি খাচ্ছে, বোঝার মতো অথনৈতিক বুদ্ধি-বিবেচনা একমাত্র হয়তো আমারই। কারণ আমি কারো খাই না, পড়িও না। ভলতেয়ারকে চিনতাম না কিন্তু তার সেই বিখ্যাত উক্তি সারাজীবনই বুকে ধারণ করে চলেছি। ভলতেয়ার বলেছিলেন, আমি তোমার মতামতের সঙ্গে একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের দাবির অধিকার বজায় রাখতে প্রয়োজনে জীবন দেবো। সুতরাং আমার লেখাতে অবশ্যই একশ্রেণির মানুষ ক্ষুন্ন হবেন কিন্তু মাহাথিরের মতো সর্বনাশ কিংবা দিল্লির গামলা-গামলা ঘি বিতরণ করে বাংলাদেশে রসগোল্লা খাওয়ার উল্টা অর্থনীতির বিরুদ্ধে জেহাদ চলবে।

ঋণ করেও যে ঘি খাওয়া যায়, উল্টা অর্থনীতির ইতিবাচক উদাহরণটি প্রেসিডেন্ট রেগানের আবিষ্কার। আমেরিকানদের ৬২ বছর বয়স হলে সেই ব্যক্তি তার বাড়ির উপর আমৃত্যু উল্টা ঋণ নিয়ে বাকি জীবন সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাতে পারে। ঋণের বিনিময়ে তাকে মাসিক কোন অংকই দিতে হবে না। কিন্তু ব্যক্তির মৃত্যুর পর বাড়ি বিক্রি করে সেই টাকা সুদে-আসলে তুলে নেবে ব্যাংক। উল্টা ঋণ দেয়ার আগে সবকিছুই আমলে নিয়ে তারপরেই ঋণ দেয় আমেরিকার ব্যাংক, যেন সুদে আসলে ব্যাংকের টাকা উঠে আসে।


এবার হাসিনার উল্টা ঋণের উদাহরণ। ৪৪ বছর পরেও বাংলাদেশের জিডিপির আয়তন ২০৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু দম্ভ শুনলে মনে হবে, ২ হাজার ৫ বিলিয়ন ডলারের জিডিপি নিয়ে কথা বলছে। জনসংখ্যার দিক থেকে ৮ম জনবহুল এবং ঘনবসতির দিক থেকে ১ম। দেশজুরে চরম অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি আর অপরাধ জর্জরিত প্রশাসন, ক্যাস্ট্রোর মতো ব্যক্তি এবং পরিবার কেন্দ্রিক দেশ, বসবাসের সবচে’ অযোগ্য রাজধানী ঢাকা। এই শহরের ৪৭.৮ ভাগ মানুষের ঠিকানা বস্তি। মানুষের নয় বরং কৃতদাসের জীবন ভোগ করছে মূলত শ্রম নির্ভর দেশটির মানুষেরা। অর্থনীতি চলছে খাতা-কলমে নয় বরং কতিপয় ব্যক্তির মুখের কথায়। পরিসংখ্যান, জরিপ, নিরপেক্ষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের বালাই নেই। তাই রানাপ্লাজা থেকে ৭ মার্ডার, বিশ্বজিৎ থেকে ফেলানি হত্যা, শিক্ষকদের বেতন থেকে বিধ্বস্থ পুঁজিবাজারকে উদ্ধার, গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন ধর্মঘট থেকে তীব্র গ্যাস সংকট... সবকিছুর উত্তর এক ব্যক্তির কাছে। যেন আলাউদ্দিনের চেরাগটি তার হাতে। গরু চুরি থেকে বৈষ্ণব বন্দনা, সবখানেই এক ব্যক্তির চেহারা।

উল্টা অর্থনীতি বোঝাতে হলে বই লিখতে হবে কিন্তু এই মুহূর্তে সম্ভব না। এই দেশে নাকি একজন প্রধানমন্ত্রী আছেন, যিনি প্রতিটি মন্ত্রীর কাজ একাই করেন। কোন মন্ত্রীকেই কোন কাজ করতে দেয় না। এর মানে হলো, পাইকারি মন্ত্রণালয়ে সবকটাই অপ্রয়োজনৗয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় রাখার সুবিধা হলো, অর্থ বরাদ্দ। কেউ জানে না, টাকা যাচ্ছে কার পকেটে। অথচ ১৫ শতাংশের বেশি শিশু শ্রমিক ঢাকা শহরেই। শাহবাগ থেকে টঙ্গি রেলস্টেশন, মধ্যরাতে গৃহহীনদের ভয়াবহ জীবন কেউ কি দেখেছেন? বঙ্গোপসাগরে ট্রলার ডুবে তরতাজা যুবকদের মৃত্যু দেখেছেন? সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই মৃত্যুর মিছিল দেখেছেন? ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এই রিফিউজি সংকট, বাংলাদেশিদের সংখ্যা কতো জানেন? পশ্চিমাদের বোমাবর্ষণের শিকার হয়ে প্রতিদিনই কতো বাংলাদেশি মারা যাচ্ছে, সেটা জানেন? উল্টা অর্থনীতির ১নং দৃষ্টান্ত যখন ১ কোটির বেশি প্রবাসী শ্রমিক রেমিটান্স পাঠায়, যখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রায় ৯০ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিকের উপর প্রবৃদ্ধির ৮৫ ভাগ নির্ভর করে। কিন্তু অবৈধ সরকারের মুখে বিলিয়ন ছাড়া শব্দ শুনেছেন? এটাই উল্টা অর্থনীতির প্রমাণ। অর্থাৎ বিলিয়নিয়ারদের দেশে কোন চাকরি নেই, তাই ১ কোটি প্রবাসী শ্রমিকই শুধু নয়, প্রতিদিনই চাকরির খোঁজে হয় বনজঙ্গলে নয় বঙ্গোপসাগরে ডুবে মরছে বাংলাদেশিরা। যে দেশে চাকরি নেই, বিলিয়ন ডলারের উন্নতি চুক্তিতে কার লাভ হবে? বিলিয়ন ডলারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক কি?

আইনমন্ত্রী বললেন, উন্নতির ট্রেন এখন লাইনে ঢুকে গেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী বললেন, উন্নতির জোয়ারে ভাসছে দেশ। হাসিনা বললেন, বুঝে নিন উন্নতির টাকা। উন্নতি ছাড়া কোন মন্ত্রী কথা বলে? যেন উন্নতি এখন মন্ত্রীদের ঘোড়া রোগ। উন্নতির সেমিনারে বিলিয়নিয়ারদের ভিড় আমাকে শুধু মানসিকভাবে উদ্বিগ্নই করেনি, প্রচুর ঘৃণাও জন্মেছে সোকলড অর্থনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবিদের উপর। যে দেশের অর্থনীতির ৮৫ ভাগই প্রবাসী শ্রমিক আর গার্মেন্টসের উপর নির্ভরশীল সেই দেশে বিলিয়নিয়ারদের বিনিয়োগের টাকা শোধ করবে কারা? নাকি রেগানের উল্টা ঋণের ফর্মূলার মতো, বাংলাদেশটাকেই বেচে টাকা তুলবে বিদেশিরা।


কাঠগড়ায় হাসিনা। সজীবের দাবি, মাহফুজ আনমকে গ্রেফতার করতে হবে, কারণ আনাম একজন রাষ্ট্রদ্রোহী, তার মাকে ১১ মাস জেল খাটিয়েছিলো। বিদেশি বিলিয়নিয়ার সজীবের পক্ষ থেকে হামেশাই এই ধরনের গাত্রদাহ বক্তব্য, আমাকে নতুন করে ভাবায়। তাহলে কি এই দেশটাকে সত্যি সত্যিই ওদের পরিবারের কাছে বিক্রি করেছি? না হলে, চর্তুদিক থেকে এই দম্ভোক্তি কেন? ৩৫ বছর বিদেশের অভিজ্ঞতায় কখনোই কোন রাষ্ট্রকে এই মাত্রায় ব্যক্তি পর্যায়ে দেখিনি। এমনকি পুতিন কিংবা ক্যাস্ট্রোও কখনো কখনো ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে বের হন। যা বলছিলাম, ১/১১কে ৭৯এর ইরানের মতোই মনেপ্রাণে সমর্থন দিয়েছিলো বাংলাদেশের মানুষ। তারা স্বৈরাচারি রাজতন্ত্র থেকে মুক্তি চেয়েছিলো। আজ যারা হাসিনামুক্ত বাংলাদেশ কামনা করে, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের অংশ অনেক বড়। অর্থাৎ সর্বসাকুল্যে ৯৫ ভাগ মানুষ হাসিনার অত্যাচারে অতিষ্ঠ। বাকি ৫ ভাগের মধ্যে যারা, টাকার ভাগ কম পড়লেই রায়বাহাদুর-খানবাহাদুরদের আসল চরিত্র বেরিয়ে আসবে। অর্থাৎ সজীবকে জানতে হবে, হাসিনামুক্ত হতে প্রহর গুণছে বাংলাদেশের মানুষ। সেই অর্থে শুধুমাত্র মাহফুজ আনামই নয়, ১৭ কোটি মানুষ দেশদ্রোহী, সবাইকেই গ্রেফতার করুন।


কোমর তুলিয়া দাঁড়াও খালেদা জিয়া। যেহারে দেশ বেচাকেনা হচ্ছে, কয়দিন পর এর চিহ্নও থাকবে না। তোমরা কি শুধুই, গোমড়া মুখে সাংবাদিকদের অভিযোগ করেই যাবে? সাংবাদিকরা তোমাদের কি দেবে? সুতরাং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজপথে নামুন।


৭১ পরবর্তী ইত্তেফাকে “স্পষ্টভাষী” নামে যিনি কলাম লিখতেন, খন্দকার আব্দুল হামিদ আমার শহরের মানুষ এবং পারিবারিক বন্ধুও। কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য যখন প্রথম ঢাকায় যাই, তার লাইব্রেরি এবং জ্ঞানভান্ডার দেখে আমি অবাক। এক কথায়, জ্ঞানের মাস্টার। পাকিস্থান আমলে শেরপুরের অনেক উন্নতি তার হাতে। যেমন প্রথম টেলিফোন, প্রথম বিদ্যুৎ, প্রথম পোস্ট অফিস ইত্যাদি। রক্ষিবাহিনী আর বাকশালের বিরুদ্ধে তার জাতীয়তাবাদি কলামগুলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পথপ্রদর্শক। দুর্ভিক্ষ এবং বাকশালের বিরুদ্ধে তার কলামগুলো চিরনবীন। এই ধরনের দেশপ্রেমিক আর কখনোই জন্মাবে কি? লেখার মাধ্যমে তিনি জিয়াউর রহমানের নজরে এলে প্রায় জোর করেই তাকে মন্ত্রী বানানো হয়। জ্ঞানের মানুষ তিনি, একসময় স্বেচ্ছায় মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়ে লেখায় ফিরে যান। ক্ষয়রোগে আক্রান্ত বুদ্ধিজীবিদের মস্তিষ্কে ফাঙ্গাস না পড়লে এই অবস্থা কি করে হলো?


মিডিয়া বর্জন কর্মসূচি জরুরি হয়ে পড়েছে। একমাত্র মিডিয়া বর্জন করলেই নরপিশাচদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। দর্শক না থাকলে মিডিয়া চলবে না এবং সেটাই প্রয়োজন। গান্ধির ব্রিটিশ পণ্য বর্জন আন্দোলনে সেটাই তো হয়েছিলো। তখন তারা নিজেরাই তাঁতের কাপড় বানিয়ে পরতো। আমাদের প্রচার মাধ্যমগুলো যতো দ্রুত গোয়েবলস হয়ে উঠছে, এভাবে আর কিছুদিন চলতে দিলে, প্রত্যেকেই একেকটা জ্যান্ত সরকারি টেলিভিশনে পরিণত হবে। ইতোমধ্যেও হয়েছে সেটাই। প্রত্যেকেই দেখুন, টেলিভিশনের মতো কথা বলছে, মানুষের রক্ত-মাংসের চিহ্ন একেবারেই নেই।

স্টার জলসা দেখা নিয়ে খুনাখুনি অব্যাহত, তবু বন্ধ নিষিদ্ধ করবে না ভারতীয় টেলিভিশন, নিষিদ্ধ করবে জামায়েত-শিবির। ভারতীয় পণ্যের কারণে দেশীয় শিল্প এবং সংস্কৃতি ধ্বংসের পথে, নিষিদ্ধ করবে না ভারতের পণ্য, নিষিদ্ধ করবে জামায়েতের সম্পদ এবং সন্তানদের নাগরিকত্ব। নদীর পানি আর ছিটমহল জিম্মি করে আদায় করছে যা খুশি, নিষিদ্ধ করবে না সুন্দরবন ধ্বংসকারীদের ভারতের বনদস্যুদেরকে কিন্তু নিষিদ্ধ করবে সোকলড যুদ্ধাপরাধিদের সন্তানদের চাকরি এবং অন্যান্য সুবিধা, যদিও ৭১এর পরে তাদের জন্ম।

মিডিয়া বর্জন কর্মসূচি হাতে না নিলে পরিসি'তি আরো ভয়ংকর হবে। জার্মানিতে হিটলার ছিলেন আর্য এবং ইহুদিরা অনার্য। সুতরাং নূরেমবার্গ ট্রাইবুন্যালকে যারাই ঢাকার ট্রাইবুন্যালের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করে, ওরা জন্মগত মূর্খ। ওদের প্রপাগান্ডা থেকে যেহেতু মুক্তি নেই, সুতরাং মিডিয়া বর্জনই একামাত্র উপায়। মূর্খরা জানে না, হিটলার আর ইহুদিদের যুদ্ধ জার্মানিকে দ্বিখন্ডিত করার জন্য নয় বরং জাতিয়তাবাদের পক্ষে। মূর্খরা জানে না, ২য় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রপক্ষ আর ৭১এর মিত্রপক্ষের পার্থক্য। মূর্খরা এটাও জানে না, ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষে, মিত্রপক্ষরা যার যার জায়গায় ফিরে গেছে কিন্তু ৭১এর ভারত সুই হয়ে ঢুকেছিলো আর এখন?

আর্য-অনার্যদের মধ্যে জাতিয়তাবাদ আর ধর্মের পার্থক্য ছিলো কিন্তু ৭১এর পক্ষ-বিপক্ষের জন্য সেটা প্রযোজ্য না হওয়ার কারণ লাহোর প্রস্থাব এবং ৪৭। ৪৭এ পাকিস্থানের পক্ষে ৯৬ ভাগ ভোট দিয়েছিলো বাঙালি মুসলমানরা। অবাঙালিরা দিয়েছিলো মাত্র ৪৯ ভাগ। অর্থাৎ পাকিস্থানীরা যতোটা পাকিস্থান চেয়েছিলো তারচে’ প্রায় শতভাগ বেশি চেয়েছিলো বাঙালি মুসলমানরা। সুতরাং এবার মিলিয়ে নিন হিটলার আর ইহুদির যুদ্ধের ফসল নূরেমবার্গ ট্রাইবুন্যাল বনাম ঢাকার শিয়া-সুন্নি ট্রাইবুন্যাল।


নিন্দা জানানোর মতো ভাষাও প্রায় শেষ হয়ে আসছে। অবলুপ্ত পূর্ব পাকিস্থানে সংখ্যালঘু জীবনের অভিজ্ঞতা পরবর্তী রিফিউজি অভিজ্ঞতা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, স্বাধীনতার বদলে রক্ষিবাহিনী আর বাকশালের অভিজ্ঞতা। ১৯৮০ সনে আমেরিকার ভিসা আর ২০ ডলার নিয়ে একা জেএফকে-তে অবতরণ। তখন থেকেই ইমিগ্রেন্ট জীবন এবং অভিজ্ঞতায় সিক্ত। ২ দিনেও বাংলাদেশে লাইন পাওয়া যেতো না, প্রতি মিনিটে মূল্য ২ ডলার, আর এখন প্লেনে বসেও ৫ সেকেন্ডে বাংলাদেশে কথা বলা যায়। রেগানের এমনেস্টি পরবর্তী সময়ে আরেক অভিজ্ঞতা, তখন রাস্থায় কোন বাঙালি দেখা যেতো না। কিন্তু এখন? বাংলাদেশিদের ভোট ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে মার্কিন নির্বাচনে কিন্তু এরাই যখন বাংলাদেশের স্বৈরাচারি শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করে শিয়া-সুন্নির মতো মারমারি করে, আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি একই সঙ্গে উপচে পড়ে আর নিন্দা জানানোর ভাষাও ক্রমশ শূন্য হতে থাকে। এখন যে অভিজ্ঞতা, ১০০টা ইয়াহিয়া খানকেও হার মানিয়েছে। আমার সংখ্যালঘু অভিজ্ঞতাকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। ৬২ থেকে ৬৯, সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরুদের মধ্যে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছিলাম।


চেতনার বিরুদ্ধে আজ আমি যুদ্ধ ঘোষণা করছি, কারণ এই শব্দটি মানুষের চিন্তাচেতনা, বুদ্ধি সবকিছুই জ্বালিয়েপুড়িয়ে ছাড়খার করে দিচ্ছে। টেলিভিশন খুললে চেতনা, পত্রিকা খুললে চেতনা, মিটিং-এ গেলে চেতনা, জন্মদিনে গেলেও চেতনা। চেতনা রোগটি জিকা ভাইরাসের মতো ক্ষুদ্র আকার থেকে এইডসের মতো মহামারি আকার ধারণ করেছে। দুঃখ প্রকাশের মতো ভাষাও ফুরিয়ে যাচ্ছে। কান্নার মতো চোখের জলও আর নেই। চেতনা বিক্রির বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা এখন সবচে’ লাভজনক। লক্ষ কণ্ঠে চেতনা সঙ্গিত, শাহবাগে চেতনার আস্ফালন, টেলিভিশন খুললেই মুরগি কবিরদের চেতনা যুদ্ধ, ক্লাশে গেলেও মুনতাসির মানুনদের চেতনা ধোলাই, স্বাধীনাতার ভাষ্কর্যের চারিদিকে চেতনা ঝাড়-দারদের মাছের মা আচরণ... আমি চেতনার রগরগে যৌনউত্তেজনা ঝলসে দিয়ে বরং স্বাভাবিক বুদ্ধির বিকাশ দেখে মরতে চাই।

 

এখানে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব, জাস্ট নিউজ বিডি ডটকম’র সম্পাদকীয় বিভাগের আওতাভুক্ত নয়।