আব্দুর রাজ্জাক থেকে নায়করাজ হয়ে উঠার গল্প

আব্দুর রাজ্জাক থেকে নায়করাজ হয়ে উঠার গল্প

ষাটের দশক থেকে অভিনয় জীবন শুরু করেন নায়ক রাজ্জাক। না, রাজসিক কোনো প্ল্যাটফর্মে শুরু হয়নি তার অভিনয় যাত্রা। নানা ঘাত প্রতিঘাত আর চড়াই উৎরাই আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অভিনয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছিল তাঁর। স্বপ্রতিভায় তিনি অভিনয়ের বিশাল ভুবনে জায়গা করে নিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে আজ যে ‘নায়করাজ রাজ্জাক’-কে সবাই এক নামে চেনেন, তিনি জন্মেছিলেন দেশ ভাগেরও আগে, ১৯৪১ সালের ২৩ জানুয়ারি। আজকের এই বাংলাদেশে নয়, অখণ্ড ভারত বর্ষে! পশ্চিম বঙ্গে।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বর্ষ ভেঙ্গে টুকরো হলে ভারতের প্রচুর মুসলমান তৎকালনি পূর্ব পাকিস্তানে আর পূর্ব পাকিস্তানের অসংখ্য হিন্দু পরিবার ভারতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু নায়ক রাজ্জাকের পরিবার মুসলমান হলেও নিজের বাস্তুভিটা ছেড়ে শুধু ধর্মীয় বিভেদের কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসেননি। তারা সেখানেই বাস করতে থাকেন। ওটাই তাদের জন্মস্থান। এইসব দাঙ্গা, জাতি বিদ্বেষের মধ্যে লালন পালন হতে থাকেন আব্দুর রাজ্জাক নামের বিস্ময়াভূত কিশোর। ধীরে ধীরে বয়স হতে থাকে তাঁর। সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম, দর্শন সবই বুঝতে শুরু করেন।

একদিন সপ্তম শ্রেনিতে অধ্যয়নকালে অভিনয়ের সুযোগ তৈরি হয় তাঁর। উঁচু, লম্বা এবং দেখতে খুব সুন্দর ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক নামের সেই সরল বালক। যাকে দেখেই স্কুলের পক্ষ থেকে মঞ্চ নাটকে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন তারই খুব প্রিয় একজন স্যার। মনের ভেতর ভয় নিয়েই নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করতে রাজি হয়ে যান তিনি। নায়করাজ রাজ্জাকের এই দীর্ঘ ক্যারিয়ার জীবনে ওই স্কুলের ছোট্ট নাটকটিতে অভিনয় করার প্রভাবকেও অস্বীকার করা যায় না। এরপর থেকে অভিনয় জগত সম্পর্কে নেশা জাগে তার। কলকাতার থিয়েটারে থিয়েটারে ঘুরেন, নাটকে অভিনয়ও করেন। কিন্তু ততোদিনে তার মাথায় ঢুকে গেছে ‘সিনেমার ভূত’! সেসময় ‘রতন লাল বাঙ্গালি’ নামের একটি ছবিতেও প্রথমবার অভিনয় করেন আব্দুর রাজ্জাক। কিন্তু তার চোখে আরো বড় স্বপ্ন! ফিল্মস্টার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে কলেজের গণ্ডি পাড় হয়ে ষাটের শুরুতে কলকাতা থেকে মুম্বাই যান শুধুই ফিল্মের উপর পড়াশুনা করতে। মুম্বাই থেকে ফিরে কলকাতায় আসেন তিনি, কিন্তু স্বপ্ন যেন অধরায় থেকে যায়। সেসময় অবশ্য আরো দুটি ছবিতে অভিনয় করেন রাজ্জাক। এরমধ্যে একটির নাম ‘শিলালিপি’।

১৯৬৪ সালে ফের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে নিজের ভিটে মাটি আঁকড়ে ধরে থাকলেও পিতৃমাতৃহীন আব্দুর রাজ্জাককে এবার চলে আসতে হয় পূর্ব-বঙ্গে। রাজনৈতিক আর ধর্মীয় দাঙ্গায় পড়ে হয়তো নিজের জন্মস্থান ছেড়ে আসেন, কিন্তু নিজের ভেতর লালিত স্বপ্নটাকে ছেড়ে আসেননি রাজ্জাক। ফলে দেখা যায় ঢাকায় এসে তিনি ঠিকই খুঁজে বের করেন চলচ্চিত্রমনা মানুষদের, থিয়েটারের মানুষদের। কিন্তু দেশান্তরিত একজন মানুষের জন্য এমন সুযোগ কে তৈরি করে দিবে? ফলে তিনি বুঝতে পারেন ‘ফিল্মস্টার’ হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবিক পক্ষে খুবই কষ্টসাধ্য। তবে মানুসিকভাবে ‘ফিল্মস্টার’ হওয়ার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দেন না তিনি। ধৈর্য ধরে থাকেন, নিজের একাগ্রতা আর বাসনাকে ধরে পড়ে থাকেন। এরইমধ্যে পাকিস্তান টেলিভিশনে একটি ধারাবাহিকে কাজ পান রাজ্জাক। ‘ঘোরাও’ নামের এই সিরিজে অভিনয় করে নিজের সামর্থটা দেখাতে পারেন একজন দেশান্তরিত মানুষ। যদিও এসবে তাঁর মোটেও তৃপ্তি নেই। তাঁর চোখ শুধু ‘ফিল্মস্টার’ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর।

একদিন পরিচয় হয় সেসময়ের নির্মাতা আব্দুল জব্বার খানের সাথে। এমন প্রতিভাবান এক তরুণকে ‘ফিল্ম’-এ কাজ করতে দেখে তিনিও হয়তো কিছুটা স্বস্তি পান। অতঃপর অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে পশ্চিম বাংলা থেকে আসা আব্দুর রাজ্জাকের একটা ঠিকুঁজি হয়।

আব্দুল জব্বার খানের রেফারেন্সে কামাল আহমেদের ছবি ‘উজালা’-তে অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে ছবির জগতে ঠাঁই করে নেন বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম নায়করাজ রাজ্জাক। এরপর ধীরে ধীরে বাংলা ছবির জগতে নিজস্ব মেধা আর স্বনির্ভরতায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন অভিনেতা হিসেবে।

দেশ স্বাধীনের আগে মহান নির্মাতা জহির রায়হানের সাথে হৃদ্যতা হয়। তাঁর ‘বেহুলা’ নামের ছবিতে প্রথমবার নায়ক হিসেবে মানুষ দেখতে পায় এক সুদর্শন চেহারার রাজ্জাককে। এরপর জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতেও অভিনয় করেন তিনি। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে রাজ্জাকের পথ চলা শুরু হলেও তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে দেশ স্বাধীনের পর। পুরো সত্তর দশকজুড়ে রাজ্জাক তাঁর অভিনয় দিয়ে বাংলা ছবির জগতকে আপন মনে ঋদ্ধ করতে থাকেন। নীল আকাশের নীচে, স্বরলিপি, মনের মত বউ, অশ্রু দিয়ে লেখা, অবুঝ বউয়ের মত কিংবদন্তিতুল্য ছবিতে অভিনয় করেন তিনি।

নিজ দক্ষতা আর অভিনয় ক্ষমতায় তিনি বাংলা চলচ্চিত্রকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে নেন। সত্তর ও আশির দশকে শাবানা, ববিতা আর কবরির সাথে তার যে ক্যামিস্ট্রি বাংলা চলচ্চিত্র দেখেছে, তা আজ অবধি অক্ষুণ্ণ।

রাজ্জাক-শাবানা, রাজ্জাক-ববিতা, রাজ্জাক-কবরি জুটিবদ্ধ সিনেমাগুলো আজও বাঙালি হৃদয়ে অম্লান। খ্যাতিমান এই অভিনেতার শারীরিক অনুপস্থিতি যে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলবে বাংলা চলচ্চিত্রে এটা নিশ্চিত, কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে তার সৃষ্টিশীলতা, বাংলা চলচ্চিত্রে তার কীর্তি যুগ যুগ ধরে সাহস যোগাবে, শক্তি যোগাবে বাংলা চলচ্চিত্রকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে। যে কিংবদন্তি তৎকালীন সময়ে উর্দু আর হিন্দির প্রাদুর্ভাবেও বাংলা চলচ্চিত্র দেখতে দর্শককে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন!

এমজে/