জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সাদেক হোসেন খোকা

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সাদেক হোসেন খোকা

মরণব্যাধী ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছেন একসময়কার জননন্দিত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। সুস্থ হয়ে উঠার আর কোনো আশা নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন বিশ্বসেরা মেমোরিয়াল স্লোন ক্যানসার সেন্টারের ডাক্তাররা।

জাস্ট নিউজ সম্পাদক মুশফিকুল ফজল আনসারীর দু’টি ফেসবুক স্টেটাসে উঠে এসেছে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা সাদেক হোসেন খোকার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন আর ক্ষমতাসীনদের প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ। সেই সঙ্গে জানা গেছে দেশের জন্য লড়ে যাওয়া এই অকুতোভয় সেনানীর অন্তিম ইচ্ছা।

বৃহস্পতিবার দেয়া ফেসবুক স্টেটাসে মুশফিকুল ফজল আনসারী লিখেছেন:

ঈমান নিয়ে মরতে চাই- খোকা ভাইয়ের অন্তিম ইচ্ছা

ম্যানহাটনের মেমোরিয়াল স্লোন ক্যানসার সেন্টারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন রকম। বিশ্বের সেরা যুক্তরাষ্ট্রের এই ক্যানসার হাসপাতালের এমন দৃশ্যের সাথে পরিচিত নন সেখানে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের কেউই। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ পালাক্রমে ছুটছেন ৫১১ নং কেবিনে। যেখানে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে গণমানুষের নেতা জনাব সাদেক হোসেন খোকা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেকটা হাসিমুখেই বরণ করছেন এই বাড়তি বিড়ম্বনা।

কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস ও যন্ত্রপাতির ভিড়ে ডাক্তারদের আশা ছেড়ে দেয়া এই শক্তমনের মানুষটির আচরণ মাঝে মাঝে অবাক করছে। কখনো অচেতন আবার কখনো সচেতন, এমন অবস্থায় পার করছেন প্রতিটি দিনক্ষন। ডাক্তার যেদিন ৩ সপ্তাহের সময়সীমা বেঁধে দেন, সেদিনও তিনি দেশে থাকা বন্ধু, সতীর্থ-স্বজনদের নিকট থেকে ফোনে দোয়া চেয়ে বিদায় নিয়েছেন।

গতকাল ওয়াশিংটন থেকে নেমে হাসপাতালের রুমে ঢুকতেই চোখ ইশারা করে আমাকে বসতে বললেন। তখনো রুম ভর্তি শুভাকাঙ্খী-স্বজন। হঠাৎ করে বললেন ‘আমি ওর সাথে একটু কথা বলবো।’ কণ্যা সারিকা হোসেন ও ছেলে প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন সবাইকে নিয়ে রুমের বাইরে গেলেন। ফিস ফিস করে বলতে লাগলেন, ‘তুমি জানো কিছু?’ আমি বলতে লাগলাম আপনি সুস্থ্য হয়ে যাবেন ইনশাল্লাহ। সবাই দোয়া করছে। তিনি বলছেন, “আরে না! আমাকে সমঝোতা করে যাতে দেশে নিয়ে যাওয়া না হয়। আমি শেষ সময়ে বেঈমান হয়ে মরতে চাইনা। ম্যাডাম জেলে। আমি ম্যাডামের সিগনাল ছাড়া কিছু করতে পারবো না। তারেক সাহেব ফোনে কথা বলেছে। সে অবশ্য এ বিষয়ে কিছু বলেনি। আমি ঈমান নিয়ে মরতে চাই।”

আর বললেন, “ইশরাকের দিকে খেয়াল রেখো”। আমি এর উত্তর কি দেবো ভেবে উঠতে না পেরে বললাম, না তা কেনো হবে। আপনার দল যা করবে ভেবে চিন্তেই করবে। ম্যাডাম নিশ্চয়ই আপনার জন্য দোয়া করছেন। আপনি এসব নিয়ে কোনো চিন্তা করবেননা। শুধু আল্লাহকে ডাকুন।

পরবর্তীতে খোকা ভাইয়ের বর্তমানে সার্বক্ষনিক সাথি সাংবাদিক মনির হায়দার জানালো, তাকেও গতকাল (বুধবার) সকালে এমন কথা বলেছেন। প্রথমে ডাক্তার জানতে চেয়েছে- আপনি কোথায়? জবাবে খোকা ভাই বলছেন- আমি জেলখানায়।তাঁর জামিন হয়েছে এমন ধারণা করে মনিরকে বলেছেন , “আমার বেলতো ( জামিন) অভিনব। এটা কিভাবে হলো! তবে আমি সমঝোতা করে যেতে চাইনা। ম্যাডাম জেলে, নেতা-কর্মী জেলে এটা আমি কেমনে করি বলো?”

ডাক্তাররা বলছেন, এরকম সময় এমনটা হতে পারে। কোনোটি তিনি সচেতন ভাবে বলছেন আর কোনোটা অবচেতন মনে।
ইশরাক বললো গতকাল তাকে ও তার বোনেকে এরকম বলেছেন এবং বলেছেন তাঁকে যেনো জুরাইন কবরস্থানে তাঁর বাবা- মার কবরের পাশে দাফন করা হয়।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির অন্যতম অংশীদার এই বীর সেনানী আজ রাষ্ট্রবিহীন। তাঁর নাগরিক পরিচয় এখন ঝুলে আছে শাসকদের লকারে। নিজ ভূমিতে চিরনিদ্রায় শায়িত হবার আকুতি কী ওদের কর্ণকুহরে পৌঁছোবে!
(খোকা ভাইকে নিয়ে এ প্রসঙ্গে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন ছেপেছে দৈনিক মানব জমিন)

গেলো মঙ্গলবার প্রথম ফেসবুক স্টেটাসে মুশফিকুল ফজল আনসারী লিখেন:

একজন মনোবিজ্ঞানীর কাজের ক্ষেত্র হচ্ছে মানুষের চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা ও আচরণ পর্যবেক্ষণ । এমন বৈশিষ্ট্য লালনের ব্রত নিয়ে পরাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা টগবগে একতরুণ একদা জায়গা করে নিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে। ভাবনায় হয়তো এমন ছিলো- একদিন দেশ সেরা মনোবিজ্ঞানী হবেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ মাত্র মানুষের মনোজগৎ চুলচেরা বিশ্লেষণে অগ্রসর না হয়ে সরাসরি আপামর মানুষের ইচ্ছা ও আকাঙ্খাকে বাস্তবে রুপ দিতে স্বাধীন ভুখন্ড প্রতিষ্ঠায় নেমে পড়লেন মুক্তির সংগ্রামে।কলম ছেড়ে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন সম্মুখ সমরে। ছিনিয়ে আনেন স্বাধীনতার লাল সূর্য। স্বাধীন বাংলাদেশে আবার ফিরে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আঙিনায়। অর্জন করেন তাঁর প্রিয় বিষয় মনোবিজ্ঞান-এ সর্বোচ্চ ডিগ্রি - এম এ।

বলছি, সাদেক হেসেন খোকার কথা। আমাদের খোকা ভাই।নিউইয়র্কের হাসপাতালে এক অচেনা খোকা ভাইকে দেখলাম গতকাল সন্ধ্যায়। আকুল অভিব্যক্তি আর যন্ত্রণা ও বেদনায় সিক্ত খোকা ভাই। অনেক কষ্টে কেবল কয়েকটি শব্দ এক করতে পারলেন; বলেলেন ‘দোয়া কইরো’। আড্ডা আর আলোচনায় কতো যে জমপেশ সন্ধ্যা পার করেছি তার কোনো ইয়ত্বা নেই। কিন্তু গতকালের সন্ধ্যার জন্য একেবারেই অপ্রস্তুত ছিলাম। হাসপাতালে আছেন প্রায় ১২ দিন। এই ১২ দিনের মধ্যে ওয়াশিংটন থেকে নিউইয়র্ক যাওয়া হয়নি। ফলে যাওয়া হয়নি ম্যানহাটনের মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যানসার সেন্টারে। ধারণা ছিলো চিকিৎসার নিয়মিত অংশ হিসাবে ভর্তি আছেন। আবার বাড়ি ফিরবেন , তখন যথারীতি আড্ডা দিতে যাবো। বিদেশ বিভুইয়ে নিউইয়র্ক গেলে খোকা ভাইয়ের বাসায়ই খাওয়া-দাওয়া আর আড্ডা। কথার ফাঁকে প্রায়ই বলতেন মনে হয় ‘বাক্স বন্দি হয়েই দেশে যাইতে হবে’। যিনি দেশমাতৃকার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়লেন, তার জন্যই দেশের মাটিকে হারাম করে দিলো অবৈধ শাসকশ্রেণী! শতমামলা, হুলিয়া আর সম্পদ বাজেয়াপ্ত কোনো কিছু বাধ গেলোনা! শেষ পর্যন্ত নিজ দেশের পাসপোর্টি পর্যন্ত আটকে দিলো ‘ওরা’।

জীবনের প্রতিটি পরতে যিনি রেখেছেন ঈর্ষনীয় সাফল্য তিনি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার প্রিয় খোকা ভাই। শুরুতে একজন ক্রীড়া সংগঠক হিসাবে তরুণদের নজর কাড়েন জনাব সাদেক হোসেন খোকা। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরেই ১৯৭২ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়নের দায়িত্ব নিয়ে ক্লাবকে তিন বছরের মধ্যে তৃতীয় থেকে প্রথম বিভাগে উন্নীত করেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জনাব খোকা ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ও ফরাশগঞ্জ ক্লাবের গভর্নিংবডির চেয়ারম্যান ছিলেন। মওলানা ভাষানীর অনুসারী বামপন্থি রাজনীতি ছেড়ে আশির দশকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন জনাব সাদেক হোসেন খোকা। ঢাকার নয়াবাজার নবাব ইউসুফ মার্কেটে বিএনপির কার্যালয় থেকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে সাতদলীয় জোটের নেতৃত্ব দেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ওই অন্দোলনে ঢাকা মহানগর সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো রণাঙ্গনের এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসন (সূত্রাপুর-কোতোয়ালি) থেকে শেখ হাসিনাকে পরাজিত করে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়ে আলোচনায় আসেন। দায়িত্ব পান যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ঢাকার আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে বিএনপি প্রার্থী পরাজিত হলেও একমাত্র খোকা নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মৎস্য ও পশুসম্পদমন্ত্রী হন।

১৯৯৬ সালে মহানগর বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন ৭১ এ হানাদার বাহীনির বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া এই গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা । দায়িত্ব পান ঢাকা মহানগর বিএনপির সভাপতির।

সোমবার বিকালে ২২০ মাইল দূরত্বে ওয়াশিংটনে বসে জানতে পারি ডাক্তারদের চরম অসহায়ত্ব। এখন ভরসা কেবল মওলার অপার অনুগ্রহ। দেশের জন্য, মানুষের জন্য সর্বদা নিবেদিত সাদেক হোসেন খোকাকে এখন সকলের দেবার পালা। আর তা হচ্ছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন’র দরবারে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা। মহান স্রষ্টাই পারেন তার সৃষ্টিকে অশেষ অনুগ্রহ করতে। আসুন আমরা এই মজলুম জননেতার জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনায় সামিল হই!

দৈনিক মানব জমিন তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে যেভাবে বর্ণনা করেছে:

শেষ ইচ্ছেও পূরণ হচ্ছে না খোকার!

শেষ ইচ্ছেটিও পূরণ হচ্ছে না বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও অবিভক্ত ঢাকার সর্বশেষ মেয়র সাদেক হোসেন খোকার। প্রিয় স্বদেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার প্রচণ্ড আঁকুতি নিয়েই দেশ থেকে বহুদূরে, সাতসমুদ্র তেরনদী পেরিয়ে হাসপাতালের বিছানায় এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তিনি। পাসপোর্ট না থাকায় এই মুহূর্তে তিনি অনেকটা দেশহীন। এ অবস্থায় যদি তিনি চলে যান না ফেরার দেশে তাহলে তার মৃতদেহটিও দেশে পাঠানোর বিষয়টি অনিশ্চিত। এ পরিস্থিতিতে তার পরিবারের সদস্যরা প্রচণ্ড হতাশ। সাবেক এই মন্ত্রীর সুস্থ হয়ে ওঠার আর কোনো সম্ভাবনা না থাকায় চিকিৎসকরা এরই মধ্যে তার ক্যানসার চিকিৎসায় ক্ষান্ত দিয়েছেন। বর্তমানে নিউ ইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোন কেটেরিং ক্যানসার সেন্টারের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে তাকে।

নিউ ইয়র্কে খোকা পরিবারের ঘনিষ্ঠজন মাহমুদ হোসাইন বাদশা মানবজমিনকে জানান, ক্যানসার চিকিৎসার জন্য ২০১৪ সালের মে মাসে একজন ভিজিটর হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন ঢাকার সাবেক মেয়র।

নিউ ইয়র্কের স্লোন কেটেরিং হসপিটালে চিকিৎসা শুরুর পর প্রতি সপ্তাহে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন ধরনের থেরাপি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাকে চিকিৎসকের নিবিড় তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়েছে। সে কারণে লম্বা সময়ের জন্য নিউ ইয়র্ক ছেড়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু ভিজিটর ভিসার নিয়মানুযায়ী প্রতি ছয় মাসের মধ্যে দু’চার দিনের জন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যেতে হতো। এভাবেই চলছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের শেষদিকে তার নিজের এবং সার্বক্ষণিক সঙ্গী স্ত্রী ইসমত হোসেনের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ওই অবস্থায় তারা নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশ কনস্যুলেটে প্রয়োজনীয় ফি জমা দিয়ে পাসপোর্ট নবায়ন বা নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও তাদেরকে পাসপোর্ট না দেয়ায় এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে খোকা যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। তার সেই আবেদন এখনো অনিষ্পন্ন। এরমধ্যে দফায় দফায় কনস্যুলেটে খোঁজ নিয়েও পাসপোর্টের কোনো হদিস মেলেনি। সর্বশেষ মাস ছয়েক আগে ইসমত হোসেন সশরীরে কনস্যুলেটে গিয়ে পাসপোর্টের দায়িত্বে থাকা প্রথম সচিব শামীম হোসেনের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু তিনি যথারীতিই পাসপোর্টের বিষয়ে কোনো সদুত্তর দেননি। অগত্যা হতাশ হয়ে ফিরে আসেন।

বাদশা জানান, বিরতিহীন চিকিৎসার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও গত কয়েক মাস ধরে সাদেক হোসেন খোকা দেশে ফেরার জন্য অনেকটা পাগলের মতো হয়ে উঠেছিলেন। তিনি বলতেন, ঢাকায় যাওয়ার পর জেলে যেতে হলে যাবো, চিকিৎসার জন্য আর আসতে না দিলেও সমস্যা নাই। দেশে গিয়েই মরবো। কিন্তু পাসপোর্ট ছাড়া দেশে যাবো কি করে? মাহমুদ হোসাইন বাদশা বলেন, কাকতালীয়ভাবে খোকার রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদনের ওপর যেদিন আঙ্গুলের ছাপ দেয়ার তারিখ ছিল সেদিন ছিল ১৬ই ডিসেম্বর। গাড়িতে চড়ে ইমিগ্রেশন অফিসে যাওয়ার সময় পুরোটা পথ নীরবে চোখের পানি ঝরিয়েছেন। এক পর্যায়ে পাশে বসে থাকা স্ত্রীকে বললেন, আজ বাংলাদেশের বিজয় দিবস। যুদ্ধ করে এইদিনে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আজ সেই বিজয় দিবসেই যাচ্ছি অন্য দেশে আশ্রয় চাইতে!

তিনি বলেন, খোকা কেবল একজন মুক্তিযোদ্ধাই নন, তিনি মেয়র হওয়ার পর রাজধানী ঢাকার অনেকগুলো সড়কের নাম মুক্তিযুদ্ধের সকল সেক্টর কমান্ডার ও খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করেছিলেন। তিনিই প্রথম বিজয় দিবসে নগরভবনে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলনমেলার আয়োজন করেছিলেন। অথচ তার মতো একজন নিখাঁদ দেশপ্রেমিক মানুষের জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় দেশে ফেরা অনিশ্চিত। এরচেয়ে পরিতাপের আর কি হতে পারে? মৃত্যুর পর কোনো বিশেষ ব্যবস্থায় তার মরদেহ দেশে নেয়া সম্ভব হলেও পাসপোর্ট না থাকায় স্ত্রী ইসমত হোসেন সঙ্গে যেতে পারবেন না। সেটা হবে আরো মর্মান্তিক বিষয়।

সাদেক হোসেন খোকার সর্বশেষ অবস্থা এবং পরিবারের চিন্তা-ভাবনার বিষয়ে জানতে চাইলে তার বড় ছেলে প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন মানবজমিনকে বলেন, ফুসফুসে মারাত্মকভাবে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ায় তার জীবন এখন বিপন্নপ্রায়। অথচ তিনি চিকিৎসা নিচ্ছিলেন কিডনি ক্যানসারের। হঠাৎ করেই ফুসফুস আক্রান্ত হলে তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হয়। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। তবে এখনো পর্যন্ত অক্সিজেন-সাপোর্ট নিয়ে বেঁচে আছেন। চেতনাও অনেকটাই ঠিক আছে। সবাইকে চিনতে পারছেন। কিন্তু কথা বলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে। তারপরও সারাক্ষণ দেশের কথা জিজ্ঞেস করেন। কেউ দেখতে এলেই জানতে চান, দেশের খবর কি। আর সারাক্ষণই চোখ বেয়ে পানি গড়াতে থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবারের চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে জানতে চইলে তিনি বলেন, আমরা খুবই বিভ্রান্তি ও হতাশার মধ্যে আছি। আব্বু-আম্মু কারো পাসপোর্ট নেই। এখন কি করবো বুঝতে পারছি না।

প্রসঙ্গত, কিডনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৪ সালের মে মাসে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসেন সাদেক হোসেন খোকা। তারপর থেকে গত সাড়ে পাঁচ বছর যাবৎ থাকছেন নিউ ইয়র্ক সিটির ইস্ট এলমহার্স্ট এলাকায় একটি ভাড়া বাসায়। সার্বক্ষণিক তার সঙ্গে রয়েছেন স্ত্রী ইসমত হোসেন। চিকিৎসার জন্য আসার চেষ্টায় ঢাকা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের বাধায় প্রথম দফা তিনি ব্যর্থ হন। পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের আদেশে তার বিদেশ গমনে বাধা দূর হলে প্রায় তিন সপ্তাহ পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ওই তিন সপ্তাহ বিলম্বের কারণেও ক্যানসার তার শরীরে অনেকটা ছড়িয়ে পড়ে বলে জানান বড় মেয়ে সারিকা হোসেন। তিনি বলেন, তারপরও নিউ ইয়র্কে চিকিৎসা শুরুর পর গত সাড়ে পাঁচ বছর ধরে তার ক্যানসার নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ায় তিনি এখন সংকটাপন্ন। পিতার সুস্থতার জন্য দেশবাসীর দোয়া চেয়েছেন সারিকা হোসেন।

জিএস/