দেখা হচ্ছে এক ডজন কর্মকর্তার সম্পদ

শতকোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ: পশ্চিম রেলে দুর্নীতির খোঁজে মাঠে দুদক

শতকোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ: পশ্চিম রেলে দুর্নীতির খোঁজে মাঠে দুদক

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে একশ’রও বেশি কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে ধারণা করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্কার ও কেনাকাটার নামে তিন বছরে ওই টাকা লোপাট করা হয়। সাবেক ও বর্তমান এক ডজন কর্মকর্তা ও বেশ কয়েকজন ঠিকাদার এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ধরে এদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদকের আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় দফতরের কয়েকটি টিম।

রেলের রাজশাহী সদর দফতর, পাকশী ও লালমনিরহাট ডিভিশনের অধীনে বিভিন্ন কাজে এ অর্থ লোপাট করা হয় বলে সূত্র জানিয়েছে।

এ বিষয়ে দুদকের রাজশাহী বিভাগীয় পরিচালক মো. মোর্শেদ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, অনুসন্ধান চলছে। শেষ হওয়ার আগে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

সূত্র মতে, বিভিন্ন স্টেশন ভবন, ফুট ওভারব্রিজ ও প্ল্যাটফরম সংস্কার, রেল সেতু রং করা, লাইনে পাথর ফেলা, রাজশাহী স্টেশনে বগি শনাক্তকরণ এলইডি সাইন লাগানো, সিগনাল যন্ত্রপাতি কেনা, ট্রেন ও লাইন মেরামতের জন্য সরঞ্জাম কেনা, কর্মচারীদের পোশাক ও জুতা কেনা, ট্রেন ও স্টেশন পরিষ্কারের সামগ্রী (ব্লিচিং পাউডার, গুঁড়া সাবান ইত্যাদি) কেনা, যাত্রীদের বসার জন্য ফার্নিচার কেনা, রাজশাহী রেল ভবনের বিভিন্ন অফিসের ভেতরের চলাচলের পথ সংস্কার, ফুলের গাছ লাগানো, রাজশাহী রেলওয়ে হাসপাতাল ভবন সংস্কার, ফার্নিচার ও ওষুধ ক্রয়- প্রভৃতি খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ ব্যয় অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক মনে করছে দুদক।

জানা গেছে, আমনুরা জংশনে ফুটওভার ব্রিজ তৈরিতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৮৭ লাখ ১৭ হাজার ৮৮০ টাকা। নাটোর স্টেশনের ফুট ওভারব্রিজ মেরামতে ২০১৭ সালের ২৪ নভেম্বর পরিশোধ করা হয়েছে ৬৯ লাখ ৪৬ হাজার ৮৩৮ টাকা।

একই সময়ে নাটোর স্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম শেডের টিন বদলে ব্যয় দেখানো হয় ৫৪ লাখ ৪৮ হাজার ৩৫৯ টাকা।

ওই বছরে চাটমোহর স্টেশনের মাত্র ৮৪ ফুট ওভারব্রিজ তৈরিতে ব্যয় দেখানো হয় ৪৬ লাখ ৩১ হাজার ২৩৩ টাকা। উল্লাপাড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের শেডের টিন বদলে ব্যয় হয়েছে ৪৮ লাখ ৯৫ হাজার ৩১৪ টাকা।

এ বছরে মৌচাক-মির্জাপুর লাইনের আটটি গার্ডার এবং মির্জাপুর-মহেড়া লাইনের ১২টি গার্ডার রং করা খাতে ৫২ লাখ ৪৪ হাজার ৯৬৭ টাকা বিল পরিশোধ দেখানো হয়েছে। এ ছাড়াও এ সময়ে করা অন্য কাজগুলোতেও বিল পরিশোধ করা হয়েছে বড় অঙ্কের।

সূত্র মতে, জরুরি প্রয়োজন দেখিয়ে এসব কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে লোকাল টেন্ডার মেথড বা এলটিএম পদ্ধতিতে। এটি বিদ্যমান সরকারি ক্রয় ও সংগ্রহ নীতিমালার পুরোপুরি লঙ্ঘন। যোগ্যতা যাচাই ছাড়াই সমঝোতার মাধ্যমে এসব কাজ দেয়া হয়েছে ঠিকাদারদের।

কাজগুলোর বিপরীতে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে- ওই পরিমাণ অর্থ খরচের কোনো সুযোগই নেই। তার পরও কাজগুলো সম্পন্ন দেখিয়ে পরিশোধ করা হয়েছে শতভাগ বিল। দুদক সূত্র আরও জানায়, এসব কাজ বা টেন্ডারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন পশ্চিম রেলওয়ের সাবেক দুই প্রধান প্রকৌশলী মো. রমজান আলী ও আফজাল হোসেন।

এছাড়া সাবেক জিএম খায়রুল আলম, সাবেক চিফ পার্সোনেল অফিসার অসীম কুমার তালুকদার, শহীদুল ইসলাম, সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক বেলাল উদ্দিন সরকার, সাবেক প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (সিসিএম) এএসএম শাহনেওয়াজসহ অন্তত ১০ কর্মকর্তাও এসব কাজে যুক্ত ছিলেন।

এ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত সম্পদের খোঁজে কাজ করছেন দুদক টিমের সদস্যরা। এ ছাড়া তারা রাজশাহী রেল ভবন থেকে সম্প্রতি উল্লিখিত কাজ ও কেনাকাটা সংক্রান্ত নথি জব্দ করেছেন।

সূত্র জানিয়েছে, মোল্লাহ কনস্ট্রাকশন, ইসলাম এন্টারপ্রাইজ, মোমিন ট্রেডার্স, সরকার অ্যান্ড ব্রাদার্স, তোফা কনস্ট্রাকশন্স, মেসার্স আশরাফুল কবির, মেসার্স সজীব অ্যান্ড ব্রাদার্স, মেসার্স আনোয়ারুল বাবু, পদ্মা ট্রেডার্স, আরটিসি, মেসার্স বদরুল আলম, এসএম এন্টারপ্রাইজ, সিটিজেন এন্টারপ্রাইজ, অনিক এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স তৌহিদ এন্টারপ্রাইজ, বিএম ইঞ্জিনিয়ারিং, এসএস কর্পোরেশন, বিশ্বাস ট্রেডার্স, আরএস কনস্ট্রাকশন, মেসার্স রমজান আলী, আরকে ট্রেডিং, অনির্বাণ ট্রেডার্স, প্যারাডাইস ট্রেডার্সসহ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ কাজগুলো সম্পন্ন করে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে ১০ থেকে ১২টি করে কাজও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।

সূত্র জানায়, এসব ঠিকাদারের একজন বদরুল আলম। তার লাইসেন্সটি তৃতীয় শ্রেণি বা সি ক্যাটাগরির হলেও বড় বড় কাজ দেয়া হয়েছে তাকে। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, বদরুল আলম সাবেক ডিজি আমজাদ হোসেনের আত্মীয়। প্রভাব খাটিয়ে তিনি কয়েক বছরে তাকে বহু কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নেন। তিনি এখনও কাজ করে চলেছেন।

এই বিষয়ে জানতে সাবেক ডিজি আমজাদ হোসেনের মোবাইলে শনি ও রোববার কয়েকবার ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। তার শ্যালক পরিচয়দানকারী বদরুল আলম যুগান্তরকে বলেন, কারো প্রভাবে নয়, নিজের যোগ্যতায় কাজ পেয়েছি। এখনও সুনামের সঙ্গে কাজ করছি।

এ বিষয়ে পশ্চিম রেলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মিহির কান্তি গুহ গণমাধ্যমকে বলেন, আমি সম্প্রতি পশ্চিম রেলের দায়িত্ব পেয়েছি। তাই পুরনো এসব বিষয়ে বলতে পারছি না। তবে এরই মধ্যে দুদকের একাধিক টিম বিভিন্ন কাজ ও প্রকল্পের ফাইলপত্র কয়েক দফায় নিয়ে গেছে।

দুদক যাকে যখন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকছে তাকে পাঠানো হচ্ছে। আমরা দুদককে দুর্নীতি তদন্তে সব ধরনের সহযোগিতা করছি। রেল জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর ভেতরের দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করে একে আরো সেবামুখী করতে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন এ কর্মকর্তা। সুত্র: যুগান্তর।