ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের হামলা

ফের আক্রান্ত রক্তাক্ত নুরেরা

ফের আক্রান্ত রক্তাক্ত নুরেরা

নিজ কক্ষে হামলায় রক্তাক্ত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি নুরুল হক নুর। হামলায় আহত হয়েছেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অন্তত ১৫ নেতা-কর্মী। তাদের কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর।

গতকাল রবিবার দুপুরে নজিরবিহীন এ হামলা চালায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নামে এর আগেও ভিপি নুরের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এ ঘটনার প্রতিবাদে আজ সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।

ওদিকে আহতদের দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবীর নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাবেক ডাকসু ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপি যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেলসহ অনেকে।

হামলার সময় ভাঙচুর করা হয়েছে ডাকসু ভিপির কক্ষের আসবাবপত্র। ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস, সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন এ হামলার নির্দেশনা দেন বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। হামলার নেতৃত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক আল মামুন। এসময় তারা বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। হামলার সময় খবর ও ছবি সংগ্রহ করতে গেলে হেনস্থার শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকরা। তাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হয়।

জানা গেছে, গ্রামীন ফোনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতিকে উকিল নোটিশ পাঠানোর প্রতিবাদে দুপুর ১২টায় টিএসসির সন্ত্রাস বিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধনের আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ। মানববন্ধন শেষে তারা মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান নেয়। সেখানে বসে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি (ছাত্রলীগের সাবেক সহ সভাপতি) আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও সাধারণ সম্পাদক (ছাত্রলীগের সাবেক উপ সম্পাদক) আল মামুন ডাকসুতে ভিপি নুরুল হক নুর ও তার অনুসারীদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন। এরপর মধুর ঘোল ঘর থেকে বের হয়ে বুলবুল ও আল মামুন সেখানে অবস্থান নেয়া ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদেরও হামলায় অংশ নেয়ার জন্য বলে। এরপর ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীরা ডাকসুর সামনে গিয়ে ডাকসু ভবনে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। কিছু নেতাকর্মী ভেতরে গিয়ে নুরুল হক নুরের অনুসারীদের ওপর হামলা চালায়।

এসময় নুরের অনুসারীরা প্রথমে প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। কিছুক্ষণ পর হামলাকারীদের সঙ্গে যোগ দেন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। এসময় সনজিত ও সাদ্দাম ভিপির কক্ষে গিয়ে নুরকে বহিরাগতদের বের করে দেয়ার নির্দেশনা দেন। কিন্তু এতে আপত্তি জানিয়ে ভিপি নুর সনজিতকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি কে? আপনি কেন ডাকসুতে এসে আমাদের ওপর হামলা চালাচ্ছেন। এসময় উভয়ের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। ভিপি নুর ও ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে যখন উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হচ্ছে ঠিক তখন ছাত্রলীগের অন্য নেতা-কর্মীরা ভিপি নুরের কক্ষে থাকা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা-কর্মীদের এক এক করে কক্ষ থেকে বের করে দেন। এরপর ভিপির কক্ষের গলিতে অবস্থান নেয়া ছাত্রলীগের এক গ্রুপ তাদের দ্বিতীয় দফায় মারধর করেন। এরপর তারা ডাকসুর সিঁড়িতে নিয়ে আসলে সেখানে থাকা আরেকগ্রুপ শিক্ষার্থীদের মারধর করে। এসময় ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুনকে ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়। এরই মধ্যে সনজিত সাদ্দাম ভিপির কক্ষ থেকে বের হয়ে মধুতে চলে যান। যাওয়ার সময় তারা ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেন আর যেন বেশি না মারা হয়।

সনজিত সাদ্দাম মধুতে যাওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা চতুর্থ দফায় নুর ও তার অনুসারীদের ওপর হামলা চালায়। চার দফা হামলায় ভিপি নুরসহ বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের অন্তত ১৫ শিক্ষার্থী আহত হয়। এরপর ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানীসহ প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা। এসময় তারা নুরসহ আহতদের হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ততক্ষণে আবারো হামলার ভয়ে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে ভিপির কক্ষে অবস্থান নেন নুরসহ নেতাকর্মীরা। এসময় আহতরা ব্যাথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। এরপর সহকারি প্রক্টররা নুরের কক্ষের সামনে গিয়ে তাদের চিকিৎসার জন্য নেয়া হবে বলে দরজা খোলার অনুরোধ করেন। অর্থনীতি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী নুরদের চিকিৎসার জন্য বাইরে নেয়ার চেষ্টা করেন।

কিন্তু আহতরা ভিসি না আসা পর্যন্ত দরজা খুলতে অস্বীকৃতি জানান। তারা বলেন, দরজা খুললে তাদের ওপর ফের হামলা চালাবে ছাত্রলীগ। কয়েক দফায় আশ্বস্ত করার পর দরজা খুললে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যান প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা। এদিকে মুখে কাপড় বেঁধে ডাকসু ভবনের সিসিটিভি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে হামলাকারীরা। পরে তারা সিসিটিভি না ভেঙে ডাকসু কর্মকর্তা থেকে জোর করে সিসিটিভির হার্ডডিস্ক নিয়ে যায়। এদিকে ঘটনার পর ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস নিজের ফেসবুক ওয়ালে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যেখানে তিনি লেখেন, ‘বহিরাগত শিবির ক্যাডারদের নিয়ে ক্যাম্পাসে হামলা ও অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিলো পাগলা নূরা।

সচেতন শিক্ষার্থী ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ স্বাধীনতা বিরোধীদের সমুচিত জবাব দিয়েছে, এই ক্যাম্পাসে কোন স্বাধীনতা বিরোধীদের জায়গা হবে না। নুরুর নাটক সবাই বুঝে গেছে!’ হামলার বিষয়ে ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন বলেন, ছাত্রলীগের নেতৃত্বে প্রশাসনের প্রশ্রয়ে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর, ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন, যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খান, ফারুক হোসেন, মশিউর রহমানসহ অন্তত ৪০ জনের ওপর হামলা হয়েছে। কারও পা ভেঙ্গে গেছে, নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে, বমি করছে, বুকের হাড় ভেঙ্গে গেছে। কেউ কেউ আইসিইউতে রয়েছে। অনেকের অবস্থা সংকটাপন্ন। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরা নিয়ে আমরা আশঙ্কা করছি। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন বলেন, আমরা চাইনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটুক। গত কয়েকদিন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ ও নুরের সঙ্গে শিবির সংশ্লিষ্টদের ধারাবাহিক সংঘর্ষের ঘটনা দেখছি। আজকেও ঐতিহ্যবাহী মধুর ক্যান্টিন ও ডাকসু ভবনে দুই পক্ষ মুখোমুখী অবস্থান করেছিল।

আমরা নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছি। আমরা দুই পক্ষকেই আহ্বান জানাই তারা যেন নিজেদের ভেতরের সমস্যা সমাধান করে নেয়। তবে হামলায় ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেন তিনি। হামলার বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বলেন, আজকের ঘটনায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সাধারণ শিক্ষার্থীরা নুরুকে প্রতিহত করেছে। এদিকে ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী অভিযোগ করে বলেন, নুরু দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ডাকসু কার্যালয় ভাঙচুর করেছে এবং ভেতর থেকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে হামলা করেছে। আগামীতে নুরুকে আর ডাকসুতে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না বলেও ঘোষণা দেন তিনি। ঘটনার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী বলেন, নুরসহ আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে পাঠিয়েছি। সেখানে সহকারী প্রক্টররা আছেন। আগে চিকিৎসা হোক, পরে সবার বক্তব্য শুনবো। এদিকে হামলার পর বিকালে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। বিবৃতি দিয়েছে ছাত্র ফেডারেশন।

সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সংবাদ সম্মেলন করেন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতারা। তারা আজ সারা দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবাদ কর্মসূচির ঘোষণা করেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হামলার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আহত অবস্থায় ২৪ জন ভর্তি হয়েছেন উল্লেখ করে তারা বলেন, তাদের মধ্যে চার জনের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন।