রোহিঙ্গারা সহসা যাবে না, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: ক্রাইসিস গ্রুপ

রোহিঙ্গারা সহসা যাবে না, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: ক্রাইসিস গ্রুপ

রোহিঙ্গাদের বিষয়ে একটি টেকসই নীতিমালা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ব্রাসেলস ভিত্তিক প্রভাবশালী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। তারা রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ আবাসন, শিক্ষার মান ও সুযোগ বৃদ্ধি এবং রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া স্থানীয়দের সহযোগিতাসহ বেশকিছু বিষয়ে টেকসই নীতিমালা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার ও তার সহযোগীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। এ নিয়ে নিজেদের ওয়েবসাইটে বিবৃতি প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরিত করার যে পরিকল্পনা বাংলাদেশ হাতে নিয়েছে তা থেকেও ঢাকার সরে আসা উচিত বলে মনে করে ক্রাইসিস গ্রুপ।

শুক্রবার প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমারের অন্তত ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। যার মধ্যে বেশিরভাগই ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে শুরু হওয়া সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃসংস অভিযানের মুখে পালিয়ে এসেছে। উদারভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে তাদের জন্য নিরাপদ অবস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু একইসঙ্গে এই উদ্বাস্তু সংকটকে একটি সাময়িক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে এর সমাধানে শুধু দ্রুত প্রত্যাবর্তনের দিকেই নজর দিচ্ছে বাংলাদেশ। ফলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বহু বছরব্যাপী দীর্ঘ সময়ের কোনো পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে না ঢাকা।

কিন্তু সেটিও সফল হচ্ছে না কারণ প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া থেমে আছে। সঙ্গে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও সহিংসতা। বাংলাদেশও কঠিনভাবে এটি মোকাবিলা করছে বলে জানায় সংস্থাটি। আগস্ট মাসে রোহিঙ্গা ও সেখানে কর্মরত এনজিওগুলোর ওপর কঠোর বাধানিষেধ আরোপ করা হয়। এতে সেখানে মানবিক সাহায্য পাঠানো ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে তা বিতরণে বাধা সৃষ্টি করছে। তাই বাংলাদেশের উচিত এসব আরোপিত বাধানিষেধ তুলে নেয়া। একইসঙ্গে সংকটের দীর্ঘমেয়াদি ধরনকে স্পষ্ট করে সহযোগীদের নিয়ে এটি মোকাবিলায় কাজ করা।

২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা সীমান্ত অতিক্রম করতে শুরু করার পর দ্রুতই বাংলাদেশ ও মিয়ানমার তাদের প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া নিয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছায়। কিন্তু সে প্রক্রিয়ায় এখনো কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। মিয়ানমারকে প্রথম থেকেই রোহিঙ্গাদের ফিরে যেতে আগ্রহী করতে প্রয়োজনীয় পরিবেশ নিশ্চিতে সচেষ্ট মনে হয়নি। অপরদিকে বাংলাদেশ ও এর বিদেশি সহযোগী রাষ্ট্রগুলোও মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে যথেষ্ট চাপ দেয়নি বলেও নিজেদের বিবৃতিতে দাবি করেছে ক্রাইসিস গ্রুপ।

বাংলাদেশি কর্মকর্তারা যদিও ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি জানেন যে রোহিঙ্গা সংকটের কোনো স্বল্প এমনকি মধ্যমেয়াদি কোনো সমাধান নেই তারপরও বাংলাদেশের সকল প্রস্তুতিই দ্রুত প্রত্যাবাসনকে সামনে রেখেই। ঢাকা মনে করে, এটি স্পষ্ট করে তুললে মিয়ানমারের ওপর চাপ কমে যাবে এবং হয়ত এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করবে যাতে সীমান্তের ওপার থেকে আরো রোহিঙ্গা চলে আসবে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আরো বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আগস্টে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে নিরাপত্তা নিয়ে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি মোকাবিলায় রোহিঙ্গাদের চলাফেরার স্বাধীনতা ও মোবাইল ফোন ব্যবহারে বাধানিষেধ আরোপ করে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে শিবিরগুলোতে চলমান এনজিওর কার্যক্রমেও বাধা দেয়া হয় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে ক্রাইসিস গ্রুপের বিবৃতিতে। বলা হয়, বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা শিবিরের বাইরে বেষ্টনী নির্মান করছে। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা শিবিরের মধ্যে নজরদারি টাওয়ার ও ক্যামেরা স্থাপন করার পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের একাংশকে বঙ্গোপসাগরের মধ্যে জেগে ওঠা একটি দ্বীপে স্থানান্তরের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ।

বিবৃতিতে বল হয়, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রতিক্রিয়া নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছে ঢাকা। যদি বাংলাদেশ সরকার একে একটি স্বল্পমেয়াদি সংকট হিসেবে দেখে যেতে থাকে এবং নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে থাকে তাহলে এই অবস্থা আরো কঠিন ও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা না থাকা ও বাংলাদেশে তাদের জন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা না থাকায় এ ধরনের কোনো অভিযান রোহিঙ্গাদের উদ্বিগ্নতা বাড়িয়ে তুলবে। এর ফলে তাদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোতে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়বে যা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকিকে আরো বৃদ্ধি করতে পারে।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশের সামনে আরো একটি রাস্তা খোলা রয়েছে বলে মনে করে ক্রাইসিস গ্রুপ। বিবৃতিতে তারা বাংলাদেশ সরকারকে রোহিঙ্গাদের ওপর আরোপিত বাধানিষেধ তুলে দিয়ে উলটো সেখানে আইনরক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতির মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে। একইসঙ্গে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের কথাও বলা হয়েছে বিবৃতিতে। বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা সংকটকে দু-এক বছরের একটি সংকট হিসেবে না দেখে রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কর্মরত এনজিওগুলোর ওপর আরোপিত বাধানিষেধ তুলে নিতে হবে। একসঙ্গে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ সুযোগ-সুবিধা, তাদের কর্মসংস্থান, সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে কাজ করতে হবে।

আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ঢাকা স্বীকার করুক বা না করুক, লাখ লাখ রোহিঙ্গা আরো কয়েক বছর বাংলাদেশে থাকবে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এই সম্ভাবনাকে বিবেচনা করা। রোহিঙ্গা সংকটের সব থেকে নির্ভরযোগ্য সমাধান হচ্ছে, সরকারকে রোহিঙ্গাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। একইসঙ্গে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগীদের সাহায্য নিশ্চিত করতে হবে। এটাই এখন একমাত্র রাস্তা যে পথে বাংলাদেশের চলা উচিত।

এমজে/