মায়ের মৃত্যু প্রসঙ্গে যা বললেন বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা ড. জিয়া হায়দার

‘অযত্ন-অবহেলায় সৃষ্ট দগদগে ঘা থেকে রক্তঝরা মৃতদেহ’

‘অযত্ন-অবহেলায় সৃষ্ট দগদগে ঘা থেকে রক্তঝরা মৃতদেহ’

"আম্মা, তোমার সন্তানেরা আজ রাষ্ট্রযন্ত্রের আবর্তে অনেক অসহায়। তাঁরা তোমাকে বাঁচাতে পারেনি, জীবনের শেষ কয়েকটি দিনে সু-চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারেনি, শান্তি দিতে পারেনি !!" প্রিয় মাকে হারিয়ে শোকে কাতর ড. জিয়া হায়দার এভাবেই নিজের বেদনা, আক্ষেপ আর মনোকষ্টের কথা প্রকাশ করেছেন।

মায়ের বিদায় মুহূর্তে ভঙ্গুর রাষ্ট্র ব্যবস্থা আর তার ঠুনকো উন্নয়ন কাঠামোর গালভরা ফিরিস্তির ব্যর্থতার প্রতি অসন্তোষের প্রকাশ ঘটেছে বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তা ড. জিয়া হায়দারের দেয়া এক আবেগঘন ফেসবুক স্ট্যাটাসে।

করোনা ভাইরাসের জন্য হাসপাতাল-প্রশাসন-রাষ্ট্রের সবযন্ত্র প্রস্তুত বলে প্রতিদিন যে গলা ফাটানো হচ্ছে জনগণের সামনে তার অসড়তা উঠে এসেছে এই কর্মকর্তার সুদীর্ঘ স্ট্যাটাসে।

বৃহস্পতিবার মায়ের মৃত্যুতে দেয়া বিশ্বব্যাংক কর্মকর্তার একটি স্ট্যাটাস বলে দেয় যেন স্বাস্থ্য সেবার জায়গাটা কত নাজুক আর দুর্বল।

জাস্ট নিউজ বিডি ডটকমে'র পাঠকদের জন্য স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো:

"আমার আম্মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে, আমাদেরকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। আজ মাত্র দুই দিন হলো। মা হারানোর অবর্ননীয় কষ্টের সাথে সাথে তাঁর চলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি আজ আমাদের ভেতরে অসংখ্য সব প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেছে। অসহায়-অপারগ সন্তান হিসেবে অসহনীয় বেদনা ভেতরটাকে কুঁকড়ে দিচ্ছে। কেন জানেন ?

মৃত্যুর পর আম্মার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছিলো জমাট বাধা রক্ত। আমার যেসব বোনেরা আম্মার দাফন-কাফনের সাথে জড়িত থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের কাছে শুনেছি, দু-দুটো কাফনের কাপড় রক্তে ভিজে গেছে। মৃত্যু-সনদে মৃত্যুর কারন হিসেবে উল্লেখ করা ছিলো, "হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়া"। সাথে হয়তোবা আরেকটি কারন থাকতে পারে - COVID-19 পজিটিভ। "হয়তো"- শব্দটা ব্যবহার করলাম, কারন এপ্রিলের ২০ তারিখে সংগৃহীত নমুনা অনুযায়ী আম্মা COVID-19 নেগেটিভ ছিলেন। এখন আমার প্রশ্ন হলো, কোন রোগী হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলে ওনার শরীর থেকে এতোটা রক্তক্ষরণ কেন হলো? এতো রক্ত কোত্থেকে আসলো যে দু-দুটো কাফনের কাপড় ভিজে গেলো ?

কর্তব্যরত ডাক্তারদের কাছ থেকে শুনেছিলাম, ৭ দিন একটানা হাসপাতাল বেডে শুয়ে থাকার জন্য আম্মার শরীরের পিঠের দিকে "সামান্য Bedsore" দেখা দিয়েছিলো। সামান্য Bedsore একজন মৃত্যু পথযাত্রীকে এতোটা রক্তাক্ত করে কীভাবে ? একজন ডাক্তার হিসেবে চিন্তা করে কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছিনা। তবে কি Bedsore সামান্য ছিলো না ? তাহলে কি আম্মার শরীরের পিঠ সহ পিছনের অংশের সমস্ত জায়গা জুড়েই "দগদগে ঘা" দেখা দিয়েছিলো - যার ফলশ্রুতিতে এই ব্যপক রক্তক্ষরণ ? তাহলে কি আম্মার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হবার মূল কারন- ঐ ঘায়ের মাধ্যমে সমগ্র শরীরে ছড়িয়ে পড়া "সেপসিস" ? যা খুব দ্রুত আম্মার হৃদযন্ত্রকে আক্রান্ত করে, এবং পরিশেষে মৃত্যু আমি জানিনা !!!

আপনারা যারা ইন্টেন্সিভ-কেয়ার ইউনিটে ভর্তি করা রোগী সম্পর্কে অল্পবিস্তর জানেন, তারা বুঝবেন ওনাদের জন্য নিবিড় স্বাস্থ্যসেবা কতোটা জরুরী | সেসব রোগীদের ঔষধের চেয়েও বেশী প্রয়োজন হয় নিবিড় সেবা | আর, যে করেই হোক সেই সেবা নিশ্চিত করতে হয় । এই ব্যাপারটা জানি বলেই কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালে আম্মাকে ভর্তি করার পর থেকে এই সেবার ব্যাপারটাকে আমরা প্রাধান্য দিচ্ছিলাম। যেহেতু, বর্তমান লকডাউন কিংবা কোয়ারেন্টাইন পরিস্থিতিতে আমরা নিজেরা ওখানে উপস্থিত হয়ে খোজ নিতে অপারগ ছিলাম, তাই আমাদের নির্ভর করতে হয়েছিলো ওখানে কর্তব্যরত ডাক্তার কিংবা নার্সদের প্রদত্ত তথ্যের উপর। এছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, নার্সিং অধিদপ্তরের কর্তা ব্যাক্তিদের অনেকেই আমার ব্যাক্তিগত বন্ধু, যারা সহযোগিতা-সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, এবং কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ তথা কর্তব্যরত ডাক্তার-নার্সদের ফোন করেছিলেন যেন আম্মার সু-চিকিৎসা হয় । কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হলো ? সুচিকিৎসার কথা না হয় বাদ দিলাম। হয়তো আম্মার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো, হয়তো ওনার চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন ছিলো আরও ভালো ব্যবস্থা সম্পন্ন কোন হাসপাতাল। কিন্তু ৭ দিনের "অযত্ন-অবহেলায় সৃষ্ট দগদগে ঘা থেকে রক্ত ঝরা মৃতদেহ" কি আসলেই আমাদের প্রাপ্য ছিলো?

হতে পারে বাংলাদেশ গরীব বা উন্নয়নশীল দেশ। কিন্তু আমরা কি "একটিমাত্র হাসপাতালকেও" এই বৈশ্বিক মহামারীর সময়ে প্রশিক্ষিত জনবল, প্রয়োজনীয় সকল যন্ত্রপাতি, ও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতাম না ? একটা স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান কতোটা অকার্যকর হলে সরকারের বড় বড় কর্তা ব্যাক্তিদের তদারকি সত্ত্বেও একজন ICU রোগীর এমন দুরবস্থা হতে পারে- সেটা কল্পনা করতে পারছেন ?

আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস- আম্মাকে ঐ ICU-তে ভর্তি করার পর থেকে মৃতদেহ বের করার পূর্ব পর্যন্ত ওনার কোন পরিচর্যাই হয়নি। হাসপাতালে দায়িত্বরত কেউই ওনার কাছে যেয়ে বুঝতে চেষ্টা করেননি- উনি কেমন আছেন। ডাক্তার কিংবা নার্স দায়িত্ব পালন করতে পারছেন কিনা, রোগীর রক্ত চলালচল স্বাভাবিক রাখতে শরীরের পজিশন পরিবর্তন করা হয়েছে কিনা, কিংবা ওয়ার্ড বয়/ ক্লীনার রোগীর কাঁথা-বালিশ পরিবর্তন করেছিলো কিনা -- এসব কিছুর খোজ কেউই নেয়নি ! সেই খোজ নেওয়ার মতো মোটিভেশান কিংবা মানসিক প্রস্তুতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কারোরই ছিলো বলে আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা। আর খোজ নেবেনই বা কেন ? উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুরোধ শুনবেনই বা কেন ? দূর্নীতির সুতোয় যে ওনারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত,... তাঁরা যে কাজে ফাঁকি দেওয়াতে কিংবা উর্ধতন কারো না কারো অপরাধের পারষ্পরিক দোসর !!.

এজন্যই আমি সবসময়ই বলি, যে দেশে রাজনৈতিক আনুকূল্য বিবেচনায় নিয়োগ কিংবা প্রমোশন দেওয়া হয়, যে দেশে মেধাকে সম্পূর্ন ভাবে উপেক্ষা করা হয়, যে দেশ এবং প্রতিষ্ঠান পুরোটাই ব্যাক্তিকেন্দ্রিক সেই দেশে আর যাই হোক ভালো আর কার্যকর সরকারী প্রতিষ্ঠান আশা করা যায় না। COVID-19 পরিস্থিতিতে দূর্নীতিগ্রস্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা শুধুমাত্র আমার আম্মাকেই কেড়ে নিলো না, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, জাতি হিসেবে আজ আমরা অমানবিকতার কোন প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি, দেশকে কোন অকার্যকর পরিনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছি !!!

আমি জানিনা মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে আম্মা কি চেয়েছিলেন ? সন্তানদের, নাতি-নাতনীদের হাতের স্পর্শ না পাওয়ার অভিমান, অনুযোগ কিংবা বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি অভিযোগ ছিলো কি ? তিনি কি মনে মনে এই ভেবে হতাশ হচ্ছিলেন যে, কষ্ট করে তিন সন্তানকে কেন ডাক্তার বানালাম? কী করলো ওরা, বা ওদের চিকিৎসা পেশার অন্যান্য সুযোগ্য সন্তানেরা- যখন প্রয়োজনটা সবচেয়ে বেশী ছিলো ? আজ তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। হয়তো বিদায়ের বেলায় বুক ভরা অনেক অভিমান ছিল। হয়তো উনি ভেবেছিলেন ওনার সুযোগ্য ডাক্তার সন্তান আর তাঁদের বন্ধু-বান্ধবরা ওনাকে সেবা দিয়ে সারিয়ে তুলবেন। কিন্তু উনি হয়তো জানতেন না যে, ওনার শত শত সন্তানতুল্য ছেলেমেয়েরা আজ রাষ্ট্রযন্ত্রের কিছু দুষ্টগ্রহের শৃংখলে আবদ্ধ। যে শৃংখল আবর্তিত হচ্ছে -- ব্যাক্তি কেন্দ্রিকতা, সুশাসনহীনতা, সর্বত্র রাজনিতিকরন, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, জবাবদিহিতার অভাব, এবং রাষ্ট্রের পরতে পরতে সীমাহীন দুর্নীতির বেড়াজালে আবর্তে |

আম্মা, তোমার সন্তানেরা আজ রাষ্ট্রযন্ত্রের আবর্তে অনেক অসহায়। তাঁরা তোমাকে বাঁচাতে পারেনি, জীবনের শেষ কয়েকটি দিনে সু-চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারেনি, শান্তি দিতে পারেনি !!

কিন্তু মহান আল্লাহতা'আলা তোমার সকল ভালো কাজের পুরষ্কার তোমাকে অবশ্যই দিবেন !!!"