নির্দেশনা মানা হচ্ছে না পোশাক কারখানায়

নির্দেশনা মানা হচ্ছে না পোশাক কারখানায়

করোনা পরিস্থিত মোকাবিলায় ঘোষিত লকডাউনের মধ্যে প্রথম ধাপে ২৬শে এপ্রিল থেকে ২রা মে পর্যন্ত ৩০ শতাংশ শ্রমিক দিয়ে সীমিত পরিসরে কারখানা চালানোর নির্দেশনা দিয়েছিল তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। পরবর্তী ধাপে শ্রমিকের সংখ্যাটি ৫০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ ছিল সংগঠনটির। কিন্তু শুরুতেই বিজিএমইএর এ নির্দেশনা মানেনি অনেক কারখানা। ৫০ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে কারখানা চালু করার অভিযোগও আছে।

ফলে নির্দেশনা না মেনে বেশিসংখ্যক শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোয় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা মুশকিল হচ্ছে। এতে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া সীমিত পরিসরের মধ্যেই প্রায় দেড় হাজার কারখানা চালু করা হয়েছে।

সম্প্রতি কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি মানছে কি না, সে বিষয়ে বেশ কয়েকটি পরিদর্শন টিম গঠন করে বিজিএমইএ।

গঠনের পর প্রতিদিনই কিছু কারখানা পরিদর্শন করে টিম। সংগঠনটির পরিদর্শন টিমের প্রতিবেদনেই এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সর্বশেষ ৪৮টি কারখানা পরিদর্শনের একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিজিএমইএ'র পরিদর্শন টিম। তাতে দেখা গেছে, ২১টি কারখানাই ৫০ শতাংশের বেশি শ্রমিক নিয়ে উৎপাদন চালাচ্ছে। মাত্র ১২টি কারখানায় ৩০ শতাংশের কম শ্রমিক কাজ করছেন। তবে শ্রমিকের মাস্ক পরিধান, হাত ধোয়ার মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করায় ৪৭টি কারখানার কার্যক্রমকে বিজিএমইএ সন্তোষজনক বলেছে।

এদিকে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সদস্য কারখানার ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটছে। ধাপে ধাপে কারখানা খোলার কথা থাকলেও সেটি অমান্য করে তাদের অনেকে আগেভাগেই উৎপাদন শুরু করেছে। দূরদূরান্ত থেকে শ্রমিক আনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেটি মানেননি অনেক পোশাকশিল্পের মালিক। একাধিক পোশাকশিল্পের মালিক স্বীকার করেন, ধাপে ধাপে শ্রমিক বাড়ানোর নির্দেশনা থাকলেও সেটি অনেক ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না। তাতে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। কারখানায় আসা-যাওয়ার পথেও একই সমস্যা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে একাধিকবার অনুরোধের পর গত ৬ই এপ্রিল কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত দেয় বাংলাদেশ গার্মেন্টস মেনুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) ও বাংলাদশ নিটওয়ার মেনুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)। পরে সেই বন্ধ ২৫ই এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এর মধ্যেই সরকারের সবুজ সংকেত পেয়ে ২৬শে এপ্রিল থেকে কারখানা খোলার প্রক্রিয়া শুরু করে সংগঠন দুটি।

সংগঠন দুটির নিদের্শনা ছিল স্বাস্থ্যবিধি মেনে আশেপাশের এলাকা থেকে ৩০ শতাংশ শ্রমিক নিয়েই কারখানা চালু করতে হবে যাতে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে শ্রমিকরা কাজ করতে পারে। পরবর্তী ধাপে শ্রমিকের সংখ্যাটি ৫০ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ ছিল। কিন্তু বিজিএমইএ’র এ নির্দেশনা উপেক্ষা করে অনেক কারখানা শুরুতেই ৫০ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে কাজ চালু করে। আর বেশিসংখ্যক শ্রমিক দিয়ে কাজ করানোয় শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা মুশকিল হচ্ছে। এতে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ছে।

এলাকাভেদে সীমিত পরিসরে ধাপে ধাপে কারখানা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিল বিজিএমইএ। এ ক্ষেত্রে তাদের নির্দেশনা ছিল, রবি ও সোমবার ঢাকার ২১৩টি কারখানা চালু হবে। আশুলিয়া, সাভার, ধামরাই ও মানিকগঞ্জের কারখানা খুলবে ২৮ থেকে ৩০শে এপ্রিল। এ ছাড়া রূপগঞ্জ, নরসিংদী ও কাঁচপুরের কারখানা ৩০শে এপ্রিল এবং গাজীপুর ও ময়মনসিংহের কারখানা চালু হবে ২ ও ৩রা মে। তবে ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত শুধুই নিটিং, ডাইং ও স্যাম্পল (নমুনা) সেকশন, ২রা মে কাটিং এবং ৩রা মে থেকে সেলাই বা সুইং সেকশন চালু করতে পারবে কারখানাগুলো। ২ ও ৩রা মে গাজীপুর ও ময়মনসিংহে কারখানা চালুর নির্দেশনা থাকলেও দুই জায়গায় বিজিএমইএর ৮৮০টি সদস্য কারখানার মধ্যে সর্বশেষ ৪১৬টিই উৎপাদন চালিয়েছে।

সীমিত পরিসরে ধাপে ধাপে কারখানা চালুর নির্দেশনা থাকলেও শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনায় সব মিলিয়ে বিজিএমইএর ৮৬৭টি সদস্য কারখানা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চালু হয়েছে। এসব এলাকায় বিকেএমইএ’র ২২৩টি ও বিটিএমএর সদস্য ৯৭টি বস্ত্রকলও উৎপাদন শুরু করেছে। তাছাড়া রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার (ইপিজেড) ৩৬৪ কারখানার মধ্যে ২৭০টি চালু হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু পোশাক কারখানাও রয়েছে।

এদিকে কারখানা খোলার খবরে ঢাকার বাইরের জেলার বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ঘরে থাকার নির্দেশনা অমান্য করে চাকরি বাঁচাতে এবং বকেয়া বেতন পাওয়ার আশায় নিজ নিজ কারখানায় ফিরতে শুরু করে। কিন্তু পোশাক শ্রমিকরা অনেক স্থানে কাজে যোগ দিতে এসে দেখতে পায় তাদের কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, শ্রমিক ছাটাই হয়েছে এবং আগের মাসের বেতনটাই দিচ্ছে না মালিকপক্ষ। সামনে ঈদুল ফিতরের উৎসব বোনাসেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ফলে শ্রমিকদের মাঝে হতাশা এবং ক্ষোভ বাড়ছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন শ্রমিকদের বেতন না পাওয়া বা বেকার হয়ে যাওয়ার ক্ষোভ থেকে সৃষ্ট অস্থিরতার কারণে সামাজিক বিশৃংখলা দেখা দিতে পারে।

অন্যদিকে এ অবস্থায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা জানান, লক ডাউন কঠোরভাবে পালন না করায় করোনা ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের আশংকা রয়েছে এবং সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পরবে।

বিজিএমইএ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় মোট শ্রমিক ১ হাজার ৯২৮। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ শ্রমিকই গত বৃহস্পতিবার উপস্থিত ছিলেন। কারখানাটি শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছে। এ ছাড়া রাখা হয়েছে শরীরের তাপমাত্রা মাপা, জীবাণুনাশক দিয়ে জুতা পরিষ্কার, হাত ধোয়াসহ নানা ব্যবস্থা। এছাড়া ঢাকার অদূরে সাভারের উলাইল এলাকার কারখানায় ১৮ হাজার শ্রমিকের মধ্যে বৃহস্পতিবার কাজ করেছেন ৫৫ শতাংশ বা প্রায় ১০ হাজার। এদের মতো অনেক কারখানা পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নির্দেশনার চেয়ে বেশিসংখ্যক শ্রমিক দিয়ে কাজ করাচ্ছে।

শিল্প পুলিশ সূত্র জানায়, কিছু পোশাক কারখানা স্বাস্থ্যবিধি মানছে। আবার কিছু কারখানা মানছে না। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে শ্রমিকদের শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা যাচ্ছে না। একেকটি মেশিনের মধ্যকার দূরত্ব ছয় ফুট রাখার কথা থাকলেও অধিকাংশ কারখানাই সেটি করতে পারেনি। তবে শ্রমিকদের মাস্ক ব্যবহার শতভাগ কারখানা নিশ্চিত করেছে।

বিজিএমইএর বলছে, ছোট ও মাঝারি মানের কারখানায় ৩০ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে কারখানা চালানোর বিষয়টি মানা যায়নি। তবে বড় কারখানায় এমনটি হয়নি।

বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, নির্ধারিত সময়ে কাজ বুঝে দিতে অনেক কারখানা মালিক নির্দেশনার চেয়ে বেশিসংখ্যক শ্রমিক কাজ করাতে বাধ্য হচ্ছেন। তাতে শ্রমিকদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা মুশকিল হচ্ছে।

বিজেএমইএ সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিল মাস শেষ হলেও ১৮৫টি পোশাক ও বস্ত্র কারখানা গত মার্চের মজুরি পরিশোধ করেনি। বকেয়া মজুরি পরিশোধ ও বিভিন্ন দাবিতে গত সপ্তাহজুড়েই রাজধানী ঢাকাসহ সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেছেন।

এদিকে শুক্রবার আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসেও (মে দিবস) বিভিন্ন স্থানে কারখানা খোলা রেখে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করার ফলে শ্রমিকরা বিক্ষোভে রাস্তায় নেমেছে। এ নিয়ে আশুলিয়া এলাকায় পুলিশের মুখোমুখিও হতে হয়েছে শ্রমিকদের। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই লকডাউন আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টি গৌণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

এমজে/