নিয়ম না মেনে ৩৭২ কোটি টাকার কাজ দেওয়ার প্রস্তাব ওয়াসা এমডির!

নিয়ম না মেনে ৩৭২ কোটি টাকার কাজ দেওয়ার প্রস্তাব ওয়াসা এমডির!

নিয়ম না মেনে ৩৭২ কোটি টাকার কাজ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে। ঢাকা ওয়াসার ‘ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট’ (ডিডব্লিউএসএনআইপি) প্রকল্পে প্যাকেজ নম্বর আইসিবি- ০২.১০ এর ৩৭২ কোটি টাকার কাজের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে ৪০ কোটি টাকা বেশি করদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে ঢাকা ওয়াসার এমডির পক্ষ থেকে। তবে সুপারিশমালায় অসঙ্গতি প্রমাণিত হওয়ায় দরপত্র পুনঃমূল্যায়ন করার নির্দেশ দিয়েছে সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্তিসভা কমিটি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই কাজে চায়না ফার্স্ট মেটালার্জিক্যাল গ্রুপ অফ কোম্পানি লিমিটেড ৪০ কোটি টাকা কমে দরপত্র জমা দেয়। কিন্তু তাদের বাদ দিয়ে ৪০ কোটি টাকা বেশি দরদাতা ও তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান চায়না কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এবং আরএফএল প্লাস্টিক লিমিটেড বাংলাদেশ কে উক্ত কাজ দেওয়ার সুপারিশ পাঠানো হয় ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে।

তৃতীয় করদাতা প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা ওয়াসার দাখিলকৃত মতামতের বিপরীতে মন্ত্রিপরিষদের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও মন্তব্য জানান। উক্ত মন্তব্যে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা বলেছে, ঢাকা ওয়াসা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সত্যকে গোপন করে মিথ্যা ও ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছে এবং কতিপয় বিষয়ে মনগড়া ও অপব্যাখ্যা দিয়ে মতামত পেশ করেছে যা সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য।

এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রমাণাদি ও আইনগত যৌক্তিকতা অনুসারে সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি স্পষ্ট সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। সেখানে বলা হয়, স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে চায়না কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো এবং আরএফএল প্লাস্টিক লিমিটেড তৃতীয় কম দরপত্র দেওয়া প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ৪০ কোটি টাকা বেশি দরপত্র দিয়েছে। এজন্য তাদের অনুকূলে সুপারিশ না করে তা বাতিল পূর্বক পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর বিধি ১১(২)(গ)(অ) অনুসারে পুনঃমূল্যায়ন করার নির্দেশ দেওয়া হলো।

সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত সর্বোচ্চ কমিটির প্রদত্ত সিদ্ধান্তের বিপরীতে ঢাকা ওয়াসা একগুয়েমির আশ্রয় গ্রহণ করে এবং মন্ত্রিসভা কমিটির পুনর্মূল্যায়নের নির্দেশ পালনে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। উপরন্ত পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ অনুসরণ করার কোনো সুযোগ নেই বলে মতামত দিয়ে এ সংক্রান্ত আইনের সরাসরি লংঘন করে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান।

অভিযোগ উঠেছে এ কাজে ঢাকা ওয়াসার এমডি তাসকিম এ খান ৩০ কোটি টাকা গ্রহণ করে ওয়াসা বোর্ড ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে বিশেষ দুটি কোম্পানীকে কাজ দেওয়ার সুপারিশ সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায় পাঠায়। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি এই প্রস্তাব বাতিল করে সর্বনিম্ন করদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার নির্দেশ দেয়।

এরপরেও তাকসিম এ খান সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে তার পাঠানো প্রস্তাব অনুযায়ী যেকোনো মূল্যে তার পছন্দের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রকৌশলী বলেন, ঢাকা ওয়াসার বর্ণিত প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকার ও এডিপির ঋণ চুক্তি অনুসারে ক্রয় পদ্ধতিতে এডিবির প্রকিউরমেন্ট গাইডলাইন ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ এর বিধিমালার মধ্যে মূলত কোনো কনফ্লিক্ট নেই। বরং ক্রয় সংক্রান্ত উভয় আইনের মধ্যে সামঞ্জস্যতা রয়েছে। ঋণচুক্তির পূর্বেই এতদ্বিষয়ে উভয় দিক হতে নিশ্চয়তা ও সমঝোতা খসড়া স্বাক্ষর করা হয়ে থাকে। তাছাড়া দরপত্র গ্রহণ, খোলা, মূল্যায়ন কমিটি গঠন ও দরপত্র মূল্যায়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে পিপিআর-২০০৮ অনুসরণ করার বিধান রয়েছে। অপরপক্ষে দরপত্র দলিল অনুযায়ী মূল্যায়ন সংক্রান্ত আইনের ব্যত্যয় যাতে না ঘটে সেজন্য তদারকি ও অনাপত্তির বিধান রয়েছে। যা প্রচলিত পিপিআর-২০০৮ আইনের পরিপন্থী নয়। এ ক্ষেত্রে যেহেতু প্রচলিত নিয়ম নীতির কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি সুতরাং এই প্রস্তাবিত দরপত্রের পুনর্মূল্যায়নের ব্যাপারে মন্ত্রিসভাকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্তের বিপরীতে ঢাকা ওয়াসা প্রদত্ত মতামত একান্তই মনগড়া ও অপব্যাখ্যার শামিল এবং অগ্রহণযোগ্য বলে মত দেয় ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার উপ সহকারী প্রকৌশলী মোঃ জহির উদ্দিন বলেন, নৈতিকভাবে একাজ চায়না কনস্ট্রাকশন সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এবং আরএফএল প্লাস্টিক লিমিটেড কে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। প্রথমত, আলোচ্য দরপত্র (এক ধাপ দুই খাম পদ্ধতি) মূল্যায়নে কারিগরিভাবে যে চারটি প্রতিষ্ঠানকে রেসপনসিভ করা হয়েছে তার মধ্যে চায়না কনস্ট্রাকশন সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো ও আরএফএল প্লাস্টিক কোম্পানি (যাদের অনুকূলে কাজটি প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে) দুটি প্রকৃতপক্ষে কারিগরিভাবে নন রেস্পন্সিভ। এখানে প্রকল্প পরিচালক তার ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে মূল্যায়ন কমিটি দ্বারা অনৈতিকভাবে ও সুকৌশলে উক্ত কোম্পানীদ্বয়কে (বিডারকে) কারিগরিভাবে রেস্পন্সিভ দেখিয়ে মূল্যায়নে প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। এডিবি বরাবর মিথ্যাভাবে উপস্থাপন করেছে এবং এডিবির চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা করেছে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

তিনি বলেন, যার জলজ্যান্ত প্রমাণ উক্ত বিডারের কাজের অভিজ্ঞতার দুটি ভুয়া সনদ। এরূপ আচরণের কারণে এই একই প্রকল্পের পূর্বের দুটি দরপত্রে এবং পরের একটি দরপত্রে আলোচ্য বিতর্কে কারিগরিভাবে নন-রেসপনসিভ ঘোষণা করা হয়েছে। মারাত্মক এই দুর্নীতির বিষয়টি নিরপেক্ষ কমিটি দ্বারা পুনর্মূল্যায়ন করলেই সত্যতা পাওয়া যাবে বলে দাবী করেন এই প্রকৌশলী।

তিনি আরো জানান, দ্বিতীয়তঃ চায়না ভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এইচআইসিসি ও চায়না ফার্স্ট মেটালার্জিক্যাল গ্রুপ অফ কোম্পানি লিমিটেড তাদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ ও দরপত্রের কারিগরি ও আর্থিক বিষয়ে তথ্য আদান প্রদান করেছে মর্মে যে ঠুনকো অভিযোগ এনে এডিবির নিকট উপস্থাপন করা হয়েছে তা একান্তভাবেই অগ্রহণযোগ্য এবং অমূলক। কারণ দরপত্র দলিলেই উল্লেখ আছে উক্ত দু'টি প্রতিষ্ঠানের কনস্ট্রাকশন ও সাব-কন্ট্রাক্টর একই কোম্পানি। ফলে যে সকল কাগজপত্রাদি যেমন, প্রোপোস্ট স্টাপিং অর্গানোগ্রাম, কনস্ট্রাকশন সিডিউল, মেথডোলজি ডিজাইন সার্ভিস ইত্যাদি একই হওয়ার কথা, যা কোন দোষনীয় নয়। এমনকি এ সকল কাগজপত্রাদির কারণে কোন দরপত্রদাতাকে ডিসকোয়ালিফাই অথবা ননরেসপন্স করার কোন বিধান নেই। কারণ দরপত্র মূল্যায়নে কোনো প্রতিষ্ঠানকে দরপত্রের নির্ধারিত মানদন্ড ভিত্তিতেই রেস্পন্সিভ হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই দিক বিবেচনায় কোনভাবেই ওয়াসা কর্তৃপক্ষ সর্বনিম্ন দরপত্রদাতা দুটি কোম্পানীকে ডিঙ্গিয়ে ৪০ কোটি টাকা বেশি দরপত্রদাতাকে উক্ত কাজ দিতে সুপারিশ করতে পারেন না।

এদিকে, চলতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে একটি প্রস্তাবপত্র দেয়। সেই কার্যবিবরণীতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, রেস্পন্সিভ সর্বনিম্ন করদাতার মধ্যে চায়না ভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এইচআইসিসি ও চায়না ফার্স্ট মেটালার্জিক্যাল গ্রুপ অফ কোম্পানি লিমিটেড তাদের নিজেদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ এবং দরপত্রের কারিগরি ও আর্থিক বিষয়ে তথ্য আদান প্রদান করার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে মর্মে এডিবি কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাখ্যায় প্রতীয়মান হয় না।

সেখানে আরো বলা হয়, বিদ্যমান তথ্যের ভিত্তিতে উক্ত প্রতিষ্ঠান দুটি গোপন চুক্তি করেছে বলে গণ্য করা যায় না মর্মে এডিবি মতামতও প্রদান করেছে। অর্থাৎ উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান দুটির গোপন চুক্তির বিষয়টি প্রমাণিত নয়। অধিকন্তু যে দরপত্রদাতার অনুকূলে কাজ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে তারা প্রথম সর্বনিম্ন মূল্য অপেক্ষা ৪০ কোটি টাকার অধিক মূল্যের দরপত্র প্রদান করেছে। যা তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেশি প্রতীয়মান হয়। আরো আলোচিত হয় যে, প্রকল্পের ব্যয় অনুমান নয় বরং তা শর্ত আরোপিত ঋণ। সার্বিক বিবেচনায় মূল্যায়ন কমিটি কর্তৃক চায়না কনস্ট্রাকশন সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আরএফএল প্লাস্টিক লিমিটেড এর অনুকূলে সুপারিশ না করে পুনর্মূল্যায়ন পূর্বক প্রথম সর্বনিম্ন করদাতা হিউবেল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের অনুকূলে সুপারিশ করা অধিকতর যুক্তিযুক্ত হবে মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ স্বাক্ষরিত সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির কার্যবিবরনীতে এহেন মন্তেব্যের পরেও ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার তাকসিম এ খান এবং প্রকল্প পরিচালক ও ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মো: কামরুল হাসান বিষয়টিকে তোয়াক্কা করছেন না। বরং অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নানা উপায়ে তৃতীয় সর্বনিম্ন করদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্যে এখনও মরিয়া। সুত্র: পরিবর্তন ডটকম।