প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি, ওয়াসা এমডির দুর্নীতির মহোৎসব

প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি, ওয়াসা এমডির দুর্নীতির মহোৎসব

ঢাকা ওয়াসা সংশ্লিষ্ট যেসব বড় বড় প্রকল্প গেল দশ বছরে হাতে নেওয়া হয়েছে তার প্রতিটিতে ব্যয় বৃদ্ধি যেন সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্প শেষ না করে নানা অজুহাতে এসব প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এমনকি কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে সম্পন্ন হওয়া কাজের তুলনায় অধিক পরিমাণ টাকা পরিশোধ করা হয়। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনও পেয়েছে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির চিত্র।

দুদকের অনুসন্ধানে পাওয়া এসব দুর্নীতি তুলে ধরে একটি সুপারিশমালা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে দিয়েছে সরকারের এ স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে বলতে গেলে দায়সারা কার্যক্রমের বাইরে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এ বিভাগ।

দুদকের দেওয়া অনুসন্ধানে এসব প্রকল্পে দুর্নীতির বিষয়ে বারবার দায়ী করা হয়েছে ঢাকা ওয়াসার বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার তাসকিম এ খানকে।

প্রকল্প কাজে দুর্নীতি ও অনিয়ম
দুদক বলছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ না করে বিভিন্ন অজুহাতে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমা ও প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ঢাকাসহ বৃহত্তর মিরপুর এলাকার পানি চাহিদা পূরণ করে মিরপুরের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমানো প্রকল্পটি ২০১২ সালে অনুমোদিত হয়। জিওবি, ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব তহবিল এবং প্রকল্প সাহায্যসহ মোট প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৫২১ কোটি টাকা। প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুন নাগাদ শেষ করা হওয়ার কথা ছিল।

পরবর্তীতে ২০১৬ সালে সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের ব্যয় ৫২ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৫৭৩ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। যার মধ্যে জিওবি ২০০ কোটি, ঢাকা ওয়াসার ১০ কোটি এবং প্রকল্প সহযোগিতা বাবদ প্রায় ৩৬৩ কোটি টাকা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ২০১৬ সালের ডিসেম্বর নাগাদ মোট কাজের অগ্রগতি ছিল ৪৬.৭২ শতাংশ। অথচ এই কাজে ঠিকাদারকে সেই সময়ের মধ্যে ৩১৩ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। যা সংশোধিত ডিপিপি মূল্যের ৫৪.৭৫ শতাংশ। এক্ষেত্রে কাজের অগ্রগতির সঙ্গে ঠিকাদারের সংশোধিত বিলের পার্থক্য অনেক বেশি। অথচ নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন হওয়া কাজের অর্ধেক পরিমান টাকা প্রদান করার কথা।

অন্তর্বর্তীকালীন পানি সরবরাহ প্রকল্পে দুর্নীতি
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ মহানগরীতে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা অটুট রাখার স্বার্থে প্রতিদিন ৪০ কোটি লিটার অতিরিক্ত পানি সরবরাহ করার জন্য গভীর নলকূপ স্থাপন ও পানির লাইন নির্মাণ বা পুনর্বাসনের জন্য ২০১৫ সালের জুন মাস থেকে ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যার ব্যয়ভার জিওবি ২৪২ কোটি টাকা, ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব ১০ কোটি টাকাসহ মোট ২৫২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়। আলোচ্য প্রকল্পে মোট ১৩২ টি গভীর নলকূপ, ৩০ টি গভীর নলকূপ রিজেনারেশন ও ৭০ কিলোমিটার পানির লাইন নির্মাণ অথবা পুনর্বাসনসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

উক্ত প্রকল্পে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ৮০ কোটি এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৫০ কোটি সহ মোট ১৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ ও ব্যয় হয়েছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ১৬২ টি গভীর নলকূপের কাজ শেষ হয়েছে মর্মে খাতাপত্রে দেখানো হয়েছে। রিভাইস ডিপিপিতে ৩৭৫ টি গভীর নলকূপ স্থাপন বা প্রতিস্থাপন, ১২০টি গভীর নলকূপ রিজেনারেশন, ১০০ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ পুনর্বাসন অন্তর্ভুক্ত করে ৬০০ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে প্রকল্পটি ডিপিপি অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় প্রথম অনুমোদিত ডিপিপির মাত্র ৫১ শতাংশ হলেও পুনরায় ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়।

প্রকল্পটি ২০১৫ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে সমাপ্ত করার কথা থাকলেও তা না করে উল্টো প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কয়েকটি গভীর নলকূপ স্থাপন ও কিছু পানির লাইন স্থাপন করা হলেও অধিকাংশ অসমাপ্ত রয়ে যায়। যে কাজ হয়েছে সেই কাজের অগ্রগতির সঙ্গে ঠিকাদারের পরিশোধিত বিলের অনেক পার্থক্য থেকে যায়। এসব অসংগতির সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পরিচালক এবং ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সম্পৃক্ত বলে দুদকের দেওয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব শেষ তদন্তেই!
এসব প্রকল্পে সুনির্দিষ্ট পরিমাণ আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ এনে ঢাকা ওয়াসা এমডির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করলেও শুধুমাত্র একটি কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে থেমে গেছে ঢাকা ওয়াসা এমডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পানি সরবরাহ অনুবিভাগ) মোঃ জহিরুল ইসলাম বলেন, দেখুন দুদক আমাদের কাছে তদন্তের প্রতিবেদন চেয়েছিল। আমরা সেটা তাদের দিয়েছি। এখন এ বিষয়ে যেকোন পদক্ষেপের বিষয়টি দেখবে দুদক।

দুদক থেকে ওয়াসা সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দুর্নীতির বিষয়ে আপনাদেরকে অবহিত করা হয়েছে। দুদকের সুস্পষ্ট দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া এবং আপনাদের তদন্ত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে পানি সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত স্থানীয় সরকার বিভাগের এ কর্মকর্তা বলেন, এটা দুদক করবে, আমাদের এই বিষয়ে কি করার আছে?