করোনার চেয়ে দুর্নীতি এখন পরাক্রমশালী: রিজভী আহমেদ

করোনার চেয়ে দুর্নীতি এখন পরাক্রমশালী: রিজভী আহমেদ

করোনার চেয়ে দুর্নীতি এখন পরাক্রমশালী বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। তিনি বলেছেন, এই সরকারের আমলে দুর্নীতি সর্বকালের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এই মহামারীর সময়েও অবিশ্বাস্য গতিতে চলছে দুর্নীতির এক্সপ্রেস ট্রেন! এই দ্রুত গতির ট্রেন থামানোর বদলে নানাভাবে প্রশ্রয় দিয়ে আসা হচ্ছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে।

তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের (ডিজি) বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, প্রতিদিনই সর্বসম্মুক্ষে করোনার নমুনা সংগ্রহ পরীক্ষার যে দৈন্যদশা দেখা যাচ্ছে সেদিকে ডিজি সাহেবের ভ্রুক্ষেপ নেই, অথচ জনগণকে করোনা নিয়ে আরো ভয়ঙ্কর ভীতির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছেন।

শনিবার সকালে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক ভিডিও কনফারেন্সে তিনি এসব কথা বলেন।

রিজভী আহমেদ বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ গত পরশু বলেছেন, ‘প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস সহসাই নির্মূল হচ্ছে না, করোনা পরিস্থিতি তিন বছর বা তার চেয়েও বেশি স্থায়ী হবে।’ তার এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি নেতা বলেন, সরকারী হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে সিএমএইচে দুই-তিন সপ্তাহ করোনা চিকিৎসা শেষে ডা. আবুল কালাম আজাদ দেশে আতঙ্ক ছড়ানোর এই তত্ত্ব কোথায় পেলেন? একজন চিকিৎসক এবং সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে জনগণের মধ্যে ভীতি ছড়ানোর অধিকার তার নেই। বরং চিকিৎসক হিসেবে মানুষকে অভয়বাণী শোনানোই তার দায়িত্ব ছিল। ভবিষ্যদ্বানী দিতে গেলেও এর সাথে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্তের উল্লেখ থাকতে হয়। কিন্তু তিনি তা করেননি। এমন খেলো কথাবার্তা কী এই সময়ে ডিজি সাহেবের মানায়?

রিজভী আহমেদ আরো বলেন, করোনাকালে সুচিকিৎসা, মানুষকে সচেতন করা ও প্রকৃত সত্য তুলে ধরার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের। কিন্তু মহামারীর সময় দুনিয়া জুড়ে সবাই যেখানে আজকের পরিস্থিতি আজকেই সামাল দেয়া নিয়ে ব্যস্ত সেখানে ডিজি আছেন দুই তিন বছরের চিন্তায়! এমনকি সবচাইতে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন ডাক্তার, সাংবাদিক, পুলিশসহ যারা করোনা মোকাবিলার সাথে যুক্ত আছেন তাদের জন্যও স্বাস্থ্য অধিদফতর বিশেষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অসুস্থ মানুষের এখন করোনা টেস্টের জন্যে রাত কাটে রাস্তায়! সরকারের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রধান আমলা হচ্ছেন ডিজি, দেশের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা নাই বা বললাম, বর্তমানে করোনার যে ঝড় বইছে তাতে বিপর্যস্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার রুগ্নদশাটাই এখন সবার চোখের ওপর ভাসছে। টেস্ট করাতে গিয়ে অনেক সুস্থ লোকও আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন! মারা যাচ্ছেন। যারা করোনা আক্রান্ত হয়নি তাদের অনেকেরই নমুনা পরীক্ষায় আসছে পজেটিভ, আবার যারা করোনা আক্রান্ত তাদের আসছে নেগেটিভ। এভাবে করোনার নমুনা পরীক্ষায় এতো ভুল ফলাফল আসছে যে, অন্যকোনো দেশ হলে ডিজি পদত্যাগ করতেন।

বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, দেশের জনগণ ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে আর কোনো চটুল বক্তব্য মন্তব্য শুনতে রাজি নয়, পরিস্থিতি সামাল না দিতে পেরে অবান্তর কথা, অন্যের ওপর দোষারোপ করে নিজেদের অজ্ঞতা-অযোগ্যতাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীনরা। জনগণ ক্ষমতাসীনদের অজ্ঞতা-অযোগ্যতার বলি হতে পারে না। প্রতিদিনই যেখানে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে জনজীবন আচ্ছন্ন হয়ে আছে, সেখানে বাকোয়াস কথা মানুষ শুনতে চায় না।

রিজভী আহমেদ বলেন, দুর্নীতিবাজদের শাস্তির বদলে রক্ষার চেষ্টায় অনিয়ম বাড়ছে। দুর্নীতিবাজরা যেন দুর্নীতির উল্লাসের নৃত্য করছে এবং এই করোনাকালে বাধাহীন দুর্নীতির উৎসব চলছে বিভিন্ন সেক্টরে। সরকারি প্রকল্পে অনিয়মের খবর প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসেছে কোনো কোনো কর্তৃপক্ষ, গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। তবে তা খুব কমই আলোর মুখ দেখে। শাস্তির বদলে অদৃশ্য কারণে রেহাই পায় দুর্নীতিবাজরা। তারপর বীরদর্পে তারা অব্যাহত রাখে দুর্নীতি।

তিনি আরো বলেন, কেবল যে নিয়োগ ও পদায়নে অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে তাই নয়, কেনাকাটা থেকে শুরু করে বদলি পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতর-মন্ত্রণালয়ের সব ক্ষেত্রে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে দুর্নীতি। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তারদের সুরক্ষায় কেনা আসল এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহ না করে নকল সরবরাহ করা, এমনকি সরবরাহকারী ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়া থেকে বোঝা যায় জনস্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকার সমর্থক কত কালোবিড়াল বসে আছে।

রিজভী আহমেদ আরো জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের অনেক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে কেনাকাটায় পুকুর চুরির খবর থেকে বোঝা যায় আমাদের স্বাস্থ্য খাত বালির বাঁধের মতো হয়ে আছে। বৃহৎ দেখালেও মূলতঃ এর ভেতরটা সারশূন্য। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি কাদের জন্য এ জিজ্ঞাসা এখন সবার। দুদক মূলতঃ বর্তমান একচক্ষু সরকারের প্রতিহিংসার পূরণের যন্ত্র।

তিনি বলেন, দেশের স্বাস্থ্যখাত কতটা নড়বড়ে, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর তা উন্মোচিত হয়েছে। স্বাস্থ্য সরঞ্জামের অভাবে করোনায় আক্রান্তদের সেবা দিতে পারছেন না চিকিৎসকরা। এমন বাস্তবতায় বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে পিপিই, ভেন্টিলেটর, মাস্ক, গগলসসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এসব স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনায় ভয়াবহ দুর্নীতির খবর প্রকাশ করেছে একটি জাতীয় দৈনিক। সেখানে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনায় যে খরচ ধরা হয়েছে, তা বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে দুই থেকে চার গুণ বেশি। এছাড়া চলমান মানবিক দুর্যোগের সময় যেখানে চিকিৎসা উপকরণের দিকে জোরালো নজর দেয়া দরকার, সেখানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বেশি ঝোঁক চিকিৎসাবহির্ভূত খাতে। চিকিৎসা সরঞ্জামে যত টাকা খরচ করা হচ্ছে, তার চেয়ে তুলনামূলক বেশি টাকা খরচ হচ্ছে সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট, সেমিনার, কনফারেন্স ও পরামর্শক খাতে।

বিএনপির এই নেতা আরো বলেন, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নেয়া ‘করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় জরুরি সহায়তা’ শিরোনামের প্রকল্পটির আওতায় এক লাখ সেফটি গগলস কেনা হবে। প্রতিটি সেফটি গগলসের দাম ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। অথচ বর্তমান বাজারে প্রতিটি সেফটি গগলস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায়। এই প্রকল্পের আওতায় মোট এক লাখ সাত হাজার ৬০০ পিপিই কেনা হবে। যার প্রতিটির জন্য খরচ ধরা হয়েছে চার হাজার ৭০০ টাকা। পিপিই কেনায় মোট খরচ হবে ৫০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। অথচ বর্তমান বাজারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব শর্ত মেনে ওষুধ অধিদফতরের সব শর্ত অনুসরণ করে বিভিন্ন কোম্পানির তৈরি ভালো মানের পিপিই বিক্রি হচ্ছে এক থেকে ২ হাজার টাকায়। এই প্রকল্পের আওতায় ৭৬ হাজার ৬০০ জোড়া বুট জুতা কেনা হবে। প্রতিটি জুতার খরচ দেখানো হয়েছে এক হাজার ৫০০ টাকা। এই খাতে খরচ ধরা হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। দেশে বর্তমান বাজারে বুট জুতা ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় মিলছে।

তিনি বলেন, চলমান করোনা সঙ্কটের মধ্যে যেখানে সব কিছু স্থবির, সেখানে এই প্রকল্পে ভ্রমণ ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ২০ লাখ টাকা। মাত্র ৩০টা অডিও-ভিডিও ফিল্ম তৈরির খরচ দেখানো হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা-যা অস্বাভাবিক। ৮০টা সেমিনার ও কনফারেন্স করে খরচ করা হবে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা- এই সঙ্কটকালে যা বিকৃত বিলাসিতার নামান্তর। সবচেয়ে বেশি অস্বাভাবিক খরচ দেখানো হয়েছে ওয়েবসাইট উন্নয়ন খাতে। মাত্র চারটি ওয়েবসাইট উন্নয়ন করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের খরচ হবে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পাঁচটি ডাটাবেইস তৈরিতে খরচ দেখানো হয়েছে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পাঁচটি কম্পিউটার সফটওয়্যার কেনায় খরচ ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ৩০টি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জন্য খরচ হবে আরো ৪৫ কোটি টাকা। এই লুটের খবর শীর্ষ ব্যক্তিরা জানলেও এখন পর্যন্ত কোনো কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সরকারের অবৈধভাবে ক্ষমতা ধরে রাখার মূল চেতনাই হচ্ছে বহুমাত্রিক দুর্নীতি ও লুটপাট। এতে প্রমাণিত হয় করোনার চেয়ে দুর্নীতি এখন পরাক্রমশালী। দুর্নীতিবাজরা নিজেদেরকে রাষ্ট্রের চেয়েও প্রভাবশালী মনে করছে।