বন্যা-নদী ভাঙনে নাস্তানাবুদ তিস্তাপারের মানুষ

বন্যা-নদী ভাঙনে নাস্তানাবুদ তিস্তাপারের মানুষ

দফায় দফায় বন্যা-নদী ভাঙনে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েছে তিস্তাপারের পরিবারগুলো। রংপুরে আকস্মিকভাবে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়া ও কমে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, তারাগঞ্জ ও পীরগাছায় বেশ কিছু এলাকাতে ছোট ছোট ব্রিজ, কালভার্ট ও যান চলাচলের সড়ক মারাত্মক ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে। কোথাও কোথাও বাঁধের পাশাপাশি ব্রিজ-কালভার্টের সংযোগ সড়ক ধসে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে তিস্তা প্রতিরক্ষা মূল বাঁধটিও। ভাঙন আতঙ্কে দিশেহারা হয়েছে পড়েছে তিস্তা ও ঘাঘট নদী পাড়ের লাখো মানুষ।

প্রথম দফা বন্যার পানি কিছুটা কমলে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেওয়া পানিবন্দি পরিবারগুলো ঘরে ফেরার চেষ্টা করছিল। কিন্তু গত তিন দিনের ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে ফের বন্যা দেখা দিয়েছে তিস্তায়। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টায় দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে নদীর পানি বিপৎসীমার (৫২ দশমিক ৬০ মিটার) ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিতসহ দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গঙ্গাচড়ায় তিস্তার বন্যা প্রটেকশন ওয়ালের তিনটি অংশে প্রায় ১৩০ মিটার অংশ ধসে পড়েছে। সেখানকার আলমবিদিতর ইউনিয়নের পাইকান আকবরিয়া ইউসুফিয়া ডিগ্রি মাদরাসার সামনে তিস্তার স্রোতে ধসে পড়েছে ৬০ মিটার বন্যা প্রটেকশন ওয়াল। এতে ওই মাদরাসাসহ পাশের পাইকান জুম্মাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাউদপাড়া আলিম মাদরাসা ও বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও সহস্রাধিক পরিবার হুমকির মুখে পড়েছে। ভাঙন ঠেকাতে সেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জিও ব্যাগ ফেলা শুরু করেছে। এছাড়াও ওই ইউনিয়নের গাটুপাড়ায় ৪০ মিটার ও বৈরাতি এলাকায় ৩০ মিটার এলাকার বন্যা প্রটেকশন ওয়ালের সিসি ব্লক ধসে গেছে। অন্যদিকে নোহালী ইউনিয়নের ফোটামারি টি হেড গ্রোয়েন ও আলসিয়াপাড়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ মূল বাঁধ ভাঙনেরর মুখে পড়েছে। সড়ক ভেঙে যাওয়ায় গজঘণ্টা ইউনিয়নের ছালাপাক থেকে গাউছিয়া বাজার এবং পূর্ব রমাকান্ত থেকে গাউছিয়া বাজার যাওয়ার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে।

গঙ্গাচড়ায় তিনটি ব্রিজের সংযোগ সড়ক ধসে গেছে। এতে করে দুটি ইউনিয়নের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ যোগযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে। রুদ্রেশ্বর এলাকায় ব্রিজের সংযোগ সড়কের ৪০ ফুট ধসে যাওয়ায় লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের পূর্ব ইচলী, পশ্চিম ইচলীসহ পাঁচ গ্রামের হাজারো মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন হয়ে যায়। মর্ণেয়া ইউনিয়নের শেখপাড়ায় ৫০ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি ব্রিজের সংযোগ সড়কের মাটি পানির তোড়ে ধসে যাওয়ায় হাজীপাড়া, মর্ণেয়া, আনন্দবাজারসহ আশপাশের গ্রামের কয়েক হাজার মানুষের চলাচলে দুর্ভোগ বেড়েছে। এছাড়া ওই ইউনিয়নের জমচওড়া এলাকায় ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি ব্রিজের সংযোগ সড়ক ভেঙে জমচওড়া, আলালেরহাট, ছালাপাকসহ আশপাশ এলাকার দুই হাজারের বেশি মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

মর্ণেয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোছাদ্দেক আলী আজাদ জানান, গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়ক ভেঙে যাওয়ায় দ্রুত এর সংস্কারের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। বাধ্য হয়ে দুর্ভোগের শিকার মানুষজন স্থানীয়ভাবে নিজস্ব উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ব্রিজের সংযোগ সড়ক সংস্কার করার উদ্যোগ নিয়েছে।

অন্যদিকে কাউনিয়ায় তিস্তা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের শতাধিক স্থানে ধস দেখা দিয়েছে। এতে বাঁধটি বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। সেখানকার বাংলাবাজার, ঠাঁকুরদাস, নাজিরদহ, বকুলতলা, মেনাজবাজারসহ আশপাশের ১৫টি গ্রামের মানুষের মধ্যে ভাঙন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ঠাকুরদাস, বকুলতলা এলাকার পশ্চিম দিকে তিস্তা ডানতীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন স্থানে পাঁচ থেকে সাত ফুট করে বড় বড় গর্ত দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নজরদারির অভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

তারাগঞ্জ উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের চকতাহিরা-দর্জিপাড়া সড়কে ব্রিজ দেবে গিয়ে প্রায় ২০ ফুট সড়ক ভেঙে গেছে। এতে করে ১০টি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন। প্রায় ৩২ বছর পূর্বে নির্মিত ব্রিজটির ডান দিকের দুটি গাইড ওয়াল ভেঙে যায়। এতে ব্রিজের বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দেয়। কিন্তু দীর্ঘদিনে তা মরামতের উদ্যোগ না নেওয়ায় ব্রিজটি এখন হুমকির মুখে পড়েছে।

এছাড়া আকস্মিকভাবে বন্যার পানি বৃদ্ধি ও কমে যাওয়ার কারণে গত কয়েক দিনে রংপুরের তারাগঞ্জ, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নের প্রায় দুই শতাধিক বাড়িঘর ও কয়েক শ একর আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।

বিভিন্ন এলাকায় সড়ক-সেতু ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান। তিনি জানান, ভাঙনরোধে তিস্তাসহ অন্যান্য নদী এলাকায় খোঁজ নিয়ে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। এছাড়াও বাঁধ রক্ষায় বিভিন্ন প্রচেষ্টা অব্যহত। অনেক জায়গায় জরুরি ভিত্তিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজনসহ স্থানীয়রা ধস মোকাবেলায় কাজ করছে। বন্যার কারণে হুমকির মুখে থাকা যোগযোগ ব্যবস্থার প্রতি খেয়াল রয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, ব্রিজগুলো রক্ষা ও সংযোগ সড়ক তৈরিতে ব্রিজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, এলজিইডি বা জেলা পরিষদ পরিকল্পনা ছাড়াই তাদের সুবিধামতো সংস্কার কাজ করছে।

এমজে/