রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানের ৮৬তম জন্মবার্ষিকী আজ

রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানের ৮৬তম জন্মবার্ষিকী আজ

বিশেষ সংবাদদাতা

আজ ৩রা নভেম্বর। নিভৃতচারী দেশপ্রেমিক রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খানের ৮৭তম জন্মদিন। আমৃত্যু যিনি নীরবে-নিভৃতে কাজ করেছেন দেশের মানুষের জন্য। যোগ্যতার সবটুকু পেশাগত জীবনে যেভাবে তিনি ঢেলে দিয়েছেন তেমনিভাবে দেশগঠনে রেখেছেন গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা।

চাকুরি বা আয়েশির তকমা বাগিয়ে নেয়ার কোনো স্বপ্ন তার ছিলোনা। দেশপ্রেমে অবিচল একজন সত্যনিষ্ট মানুষ। ১৯৫২ সালে তৎকালীন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দিলেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সহ্য করেছেন পাকিস্তান সরকারের গৃহবন্দিত্বের খড়গ। কিন্তু জন্মভূমির জন্য কোনো আপোষে যাননি তিনি।

বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অধিকারী রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান ১৯৩৪ সালের এই দিনটিতে সিলেটের বিরাহীমপুরের সম্ভ্রান্ত ও বিখ্যাত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তৎকালীন ভারতের প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার আহমেদ আলী খান তার পিতা।

মাহবুব আলী খানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের উদ্যেগ নিয়েছে মরহুমের পরিবার এবং রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান স্মৃতি কমিটি ঢাকা ও সিলেট।

মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জন্মদিন উপলক্ষে কোরআন খানি এবং কোরআন খতমের পর বনানীতে তার মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে।এছাড়া ঢাকা, সিলেট, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন মসজিদে বিশেষ মুনাজাত অনুষ্ঠিত হবে।

এতে আরো বলা হয়, জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দেশের পাশাপাশি সৌদি আরবের মক্কা, মদীনা, যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ব্রীকলেন মসজিদ এবং মালয়েশিয়ার পুত্রজায়ায় পুত্র মসজিদে বিশেষ প্রার্থনা করা হবে।

একনজরে কর্মজীবন

১৯৫২ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেন মাহবুব আলী খান। ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণ লাভ করেন কোয়েটার সম্মিলিত বাহিনীর স্কুল থেকে। যুক্তরাজ্যের ডার্মউইথ রয়্যাল নেভালকলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর রণতরী ট্রাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৫৬ সালের মে মাসে স্থায়ী কমিশন লাভ করেন। রয়্যাল কলেজ, গ্রিনিচসহ ইংল্যান্ডের রয়্যাল নেভাল ইনস্টিটিউশনে বিভিন্ন কোর্স সমাপ্ত করেন।

১৯৬৩ সালে কৃতী অফিসার হিসেবে যুক্তরাজ্যে রানী এলিজাবেথ কর্তৃক পুরস্কৃত হন। একই বছর যুক্তরাজ্যে ভূমি থেকে টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার অফিসার হিসেবে উত্তীর্ণ হন এবং পাকিস্তান নেভাল স্টাফ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট কোর্স সম্পন্ন করেন। এর আগে ১৯৬০ সালে পিএনএস তুগ্রিলের গানারি অফিসার হন। পরে ১৯৬৪ সালে পিএনএস টিপু সুলতানের টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন অফিসার হন। ১৯৬৭-৬৮ সালে তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে জয়েন্ট চিফ অফ সেক্রেটারিয়েট স্টাফ অফিসার (ট্রেনিং এবং মিলিটারি অ্যাসিস্ট্যান্স) হিসেবে দায়িত্ব পালন।

১৯৭০ সালে পিএনএস হিমালয়ে টর্পেডো ও অ্যান্টি-সাবমেরিন স্কুলের অফিসার ইনচার্জ ও করাচিতে সি-ওয়ার্ড ডিফেন্স অফিসারের দায়িত্বপালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে স্ত্রী ও কন্যাসহ মাহবুব আলী খান পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরিরত ছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে পরিবারসহ তিনি গৃহবন্দী হন। তিন বছর বন্দী থাকার পর ১৯৭৩ সালে স্ত্রী ও কন্যাসহ আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে বাংলাদেশে পৌঁছেন।

এরপর ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম মার্কেন্টাইলএকাডেমির প্রথম বাংলাদেশী কমান্ড্যান্ট নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সালে নৌ-সদর দপ্তরে পারসোনেল বিভাগের পরিচালক পদে নিয়োগ পান। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি নৌবাহিনীর সহকারি স্টাফ প্রধান (অপারেশন ওপারসোনেল) নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে রয়্যালনেভি কর্তৃক হস্তান্তরিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম রণতরী বিএনএস ওমর ফারুক (সাবেক এইচএমএম ন্যাভডক) এর অধিনায়ক হন। রণতরীটি নিয়ে আলজেরিয়া, যুগোশ্লোভিয়া, মিসর, সৌদি আরব এবং শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলোতে শুভেচ্ছা সফর করেন। ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর তিনি নৌবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন এবং ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি রিয়ার এডমিরাল হিসাবে অভিষিক্ত হন।

বর্ণীল পেশাগত জীবনে মেধা, দক্ষতা, আর পেশাদারিত্বে খুব অল্প সময়েই নিজের পরিচিতি তৈরি করে নিয়েছিলেন মাহবুব আলী খান। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের আধুনিক নৌবাহিনী তার হাত ধরেই তৈরি হয়েছিলো। তবে তার পরের যাত্রাটা ছিলো দেশের মাটি মানুষের সঙ্গে আরো গভীরের। অংশ নিয়েছিলেন বিস্তৃত পরিসরের দেশ গড়ার কাজে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে বিশ্বমানের আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। নৌবাহিনীর আইন প্রণয়ন করেছেন তিনি। দেশের সমুদ্রসীমা রক্ষা, সমুদ্রে জেগে ওঠা দ্বীপসহ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের দখল রক্ষা, জলদস্যু দমন, সুন্দরবনের নিরাপত্তায় নৌবাহিনীকে সচেষ্ট করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর বেতন ও পেনশন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া দেশের প্রশাসনিক পুনর্গঠনে জাতীয় বাস্তবায়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন। ১৯৮২ সালে দেশে সামরিক আইন জারি হলে, রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। এ সময় তাকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা করা হয়। ১৯৮২ সালের ১০ জুলাই থেকে ১৯৮৪ সালের ১ জুন পর্যন্ত তিনি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় শাহজালাল সেতু, লামাকাজী সেতু, শেওলাসেতুসহ বড় বড় উন্নয়ন কাজের সূচনা হয়। দেশের রাস্তাঘাট, সেতু নির্মানসহ অবকাঠামো উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখেন তিনি।

১৯৮২ সালের এপ্রিল মাসে রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান নৌ, রেল ও সড়ক প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে চীন সফর করেন এবং চীনের নৌঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করেন। জুন মাসে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন। একই বছর নভেম্বরে তিনি রাশিয়া গমন করেন এবং প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ডিসেম্বরে জ্যামাইকায় অনুষ্ঠিত সমুদ্র আইনবিষয়ক সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন ও কনভেনশন অন অফ-সি কনফারেন্সে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেন। ১৯৮৩ সালের মার্চে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত রেলওয়ে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। জুলাই মাসে তিনি কোরিয়া সফরে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৪ সালের ৩০মার্চ তিনি গিনির প্রেসিডেন্ট আহমদ সেকুতুরের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সঙ্গে মাহবুব আলী খানের সম্পর্ক ছিল অতন্ত ঘনিষ্ঠ। ১৯৭৫ সালের পরে, জিয়াউর রহমান সরকারের সময় নৌবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি তৎকালীন সরকারের যোগাযোগ উপদেষ্টা ছিলেন। মাহবুব আলী খান শহীদ জিয়া সূচিত সবুজ বিপ্লব ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম সহযোগি হিসাবে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। সৎ ও অভিজ্ঞ মাহবুব আলী খানকে পরবর্তী সরকার বাংলাদেশের যোগাযোগ ও কৃষিমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করে।

১৯৮৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকায় খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে অবতরণ করার সময় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফকার এফ২৭-৬০০ জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের (এখন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) কাছাকাছি একটি জলাভূমির মধ্যে বিধ্বস্ত হয়। বিমানটি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পূর্বনির্ধারিত ঘরোয়া যাত্রী ফ্লাইট পরিচালনা করছিল। সে ঘটনায় মোট ৪৯ জন যাত্রি মারা যান। ফ্লাইট পরিচালনাকারী বাংলাদেশের প্রথম মহিলা পাইলট কানিজ ফাতেমা রোকসানাও মর্মান্তিক ওই বিমানদূর্ঘটনায় নিহত হন। রিয়ার এডমিরাল মাহবুব আলী খান তাৎক্ষণিক ছুটে যান দূর্ঘটনাস্থলে। সেখানে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে স্থানান্তর করা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। ৬ আগস্ট মাত্র ৪৯ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন নিভৃতচারী এই ক্যাপ্টেন।

তার মৃত্যুতে গভীর শোক আর সমবেদনা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন রানী এলিজাবেথ, সৌদি আরবের বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক, থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল প্রেম থিনসুলাননদা এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা।