ফের রণক্ষেত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গুলিতে নিহত ৩

ফের রণক্ষেত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গুলিতে নিহত ৩

হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে টালমাটাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া। দফায় দফায় সংঘর্ষ, বিক্ষোভ, ভাঙচুর হয়েছে শহরজুড়ে। সরাইলে থানায় হরতালকারীরা হামলা করলে গুলিতে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। জেলা শহরে মারা গেছেন আরো একজন। হরতাল চলাকালে বিভিন্ন সরকারি অফিস, সংগঠনের কার্যালয়ে নির্বিচারে হামলা ও ভাঙচুরের পর আগুন দেয়া হয়। হামলা হয়েছে প্রেস ক্লাবেও। এ সময় শহরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল পুরোপুরি অনুপস্থিত। এসব ঘটনায় প্রেস ক্লাব সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামিসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। আহতদের জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়।

জেলায় দুইদিনে বিজিবি ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে মোট ৮ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সরাইলে ২ জন, সদর উপজেলার নন্দনপুরে ৫ জন ও জেলা শহরে ১ জন নিহত হয়। সকাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করছিলেন হেফাজতের নেতাকর্মীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্নস্থানে হামলা ও আগুন দিতে শুরু করেন তারা। সকালে শহরের পীরবাড়ি এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের হলে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। একই সময়ে শহরের পৈরতলায় পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের সঙ্গেও সংঘর্ষ বাধে। এরপরই একযোগে বিভিন্নস্থানে হামলা ও ভাঙচুর শুরু হয়।

জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকারের বাসা, অফিস ভাঙচুর করা হয়। তার শ্বশুরবাড়িতে হামলা চালিয়ে একটি প্রাইভেটকার ভাঙচুর করা হয়। হামলা হয় পৌরসভার মেয়র নায়ার কবিরের বাসাতেও। বাসার নিচতলায় থাকা একটি দোকান ভেঙে মালামাল লুট করে নেয়া হয়। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম রুবেল, সাধারণ সম্পাদক শাহাদাৎ হোসেন শোভনের বাড়ি, জেলা পরিষদ ভবন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভায় ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়। আগুন দেয়া হয় ধীরেন্দ্র নাথ ভাষা চত্বরের বিভিন্ন সংগঠনের অফিসে। হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয় সদর ভূমি অফিসে, সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, সেখানকার এশিয়া ব্যাংকের শাখাটিতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। এই ঘটনার সময় পুরোপুরি মাঠ ছাড়া ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সদর থানার প্রধান ফটক তালা দিয়ে ভেতর থেকে হরতালকারীদের উদ্দেশ্যে মাইকে বারবার বলা হয়, সদর থানা আপনাদের, দয়া করে থানায় হামলা করবেন না। আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করুন, আমরা আপনাদের পাশে আছি। চারদিকে আগুনে সরকারি অফিস-বাসাবাড়ি পুড়লেও দমকল বাহিনী ফটক তালা দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই ব্যস্ত ছিল। ফলে চোখের সামনে আগুনে পুড়েছে সবকিছু। তাদের জানিয়েও সহায়তা পাননি ক্ষতিগ্রস্তরা। প্রত্যেকটি স্থানে দফায় দফায় হামলা চালানো হয়। কয়েক দফা ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। এর আগে সিসি ক্যামেরা খুলে নেয় হামলাকারীরা। ঘটনার খবর পেয়ে প্রেস ক্লাবে ছুটে আসার পথে হামলার শিকার হন প্রেস ক্লাব সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামি। তাকে জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়।

হেফাজতের দাবি: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গত দু’দিনের ঘটনায় রোববার সকালে ৮ জন, পরে বিকালে ১৬ জন নিহত হয়েছে বলে হেফাজতে ইসলামের নেতারা দাবি করেন। বিকালে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মুফতি মো. মোবারক উল্লাহ হরতাল শেষে মোনাজাত করার সময় ১৬ শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। পাশাপাশি আহতদের সুচিকিৎসার দাবি জানান। এর আগে সকালে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমীর মাওলানা সাজিদুর রহমান কুমিল্লার কোম্পানীগঞ্জে ২ জনের মৃতদেহ রয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান। এ ছাড়া আরো অনেক মাদ্রাসা ছাত্র গুরুতর আহত ও নিখোঁজ রয়েছে বলেও জানান তারা। আহতদের অনেকে ঢাকায় চিকিৎসা নিচ্ছেন।

সরাইলে হাইওয়ে থানায় ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, গুলিতে নিহত ২: হরতাল চলাকালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সরাইলের বিশ্বরোড হাইওয়ে থানায় হামলা করেন হেফাজতের কয়েক হাজার লোক। এক পর্যায়ে তারা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশ সদস্যরা তখন গুলি ছুড়তে ছুড়তে ফাঁড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। পরে পুলিশ ও হেফাজতের মধ্যে চলে হামলা-পাল্টা হামলা। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে দোকানের কর্মচারী কালন মিয়া (২২) নামের এক যুবক ও আল-আমীন (১৪) নামের এক শিশু মারা যায়। গতকাল রোববার সকাল ১১টার দিকে মহাসড়কের বিশ্বরোড এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বেলা ১টার পর ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা সরাইল থানায় এসে আশ্রয় নেন।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টার দিকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি সরাইল হাসপাতালের মোড় থেকে দ্রূতগতিতে উপজেলা চত্বরের দিকে যেতে থাকে। বিক্ষোভকারীরা সরাইলের প্রধান সড়কের দুই পাশের আওয়ামী লীগের ব্যানার- ফেস্টুন লাঠি দিয়ে আঘাত করে ছিঁড়ে ফেলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে স্থানীয় হেফাজত নেতারা হাসপাতাল মোড়ে পথসভা করেন। সেই সভায় মাইকে ঘোষণা দেন সকাল ১১টার পর সরাইলে হরতাল স্থগিত করা হলো। ১১টার পর যদি কেউ কোনো অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করেন সেই দায়-দায়িত্ব আপনাদের। হেফাজতে ইসলাম কোনো দায়িত্ব নেবে না। মাওলানা মাঈনুল ইসলাম মুঠোফোনে জানান, সকাল ১০টায় কিছু যুবক ও কিশোর লাঠি হাতে আমাদের মিছিলে যোগ দেয়। ওরা কারা? কোথা থেকে এসেছে? সেটা জানি না। তাদেরকে আমরা চিনিও না। বাধ্য হয়ে ১১টার পর সরাইলের হরতাল স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছি। ঠিক এ সময় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বিশ্বরোড মোড়েও আরেকটি বড় গ্রুপ পিকেটিং করছিল। সরাইলে হরতাল স্থগিত ঘোষণার পরই একটি গ্রুপ লাঠি হাতে দ্রুতগতিতে চলে যায় মহাসড়কে। দুই গ্রুপ মিলে মিছিল করে হাইওয়ে থানার দিকে যেতে থাকে। থানার সামনে রাখা জলকামানটি প্রথমে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। এরপর জলকামানে আগুন ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়। কিছুক্ষণ পর হরতালকারীরা থানায় হামলা চালায়। প্রথমে ফাঁড়ির সামনে থাকা জলকামানটি ভাঙচুর করে।

পরে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে থানার দরজা জানালা ভেঙে ফেলে। পুলিশের কোনো সাড়া না থাকায় হরতালকারীরা ফাঁড়ির ভেতরে প্রবেশ করে লুটপাটের তাণ্ডব চালায়। এ সময় ফাঁড়ির গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডপত্র ও রেজিস্ট্রারও নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত থানায় অগ্নিসংযোগ করে। আগুন দেয়ার পর পুলিশ সদস্যরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বেরিয়ে আসেন। সড়কের উপর হেফাজতের সঙ্গে হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে। লোকজনের উপস্থিতি বাড়তে থাকলে হাইওয়ে ছেড়ে পুলিশ সদস্যরা বেলা ১টার পর সরাইল থানায় চলে আসেন। দোকানে বাঁশ-বেতের কাজ করা অবস্থায় গুলিতে নিহত হয় সদর উপজেলার খাঁটিহাতা গ্রামের আলতু মিয়ার ছেলে কালন মিয়া।

কালন মিয়ার বুকের মাঝখানে গুলিবিদ্ধ হলে মারা যান। আর কুট্রাপাড়া গ্রামের শফি মিয়ার ছেলে আল-আমীনের ডানদিকে কিডনি বরাবর বাম উরুতে একটি গুলি লাগে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যায় আল-আমীন। হামলায় আহত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ওসি গাজী মো. শাখাওয়াত হোসেন, এস আই মোয়াজ্জেম, এস আই শওকত, সার্জেন্ট মাইদুল ও এম হাসান আলীর নাম জানা গেছে। নিহত কালনের জানাজা হয়েছে গতকাল বাদ আসর গ্রামের মাদ্রাসা মাঠে। আর আল-আমীনের জানাজা হয়েছে বাদ মাগরিব। সন্ধ্যা ৬টার দিকে বিজিবি, পুলিশ ও এপিবিএন’র সদস্যরা বিশ্বরোড ফাঁড়ি এলাকায় আসেন।