রাজধানীর রামপুরা এলাকার শাখা গলি দিয়ে কিছুক্ষণ যেতেই মানুষের জটলা চোখে পড়ে। একজন মধ্যবয়সী ব্যক্তি হাত-পা ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। মাথাটা পেছনের প্রাচীরে ঠেকানো। জানা গেল, তিনি বাসচাপায় নিহত শিক্ষার্থী মো. মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়ের বাবা আব্দুর রহমান। স্বজনরা তাকে ঘিরে রয়েছেন। মাইনুদ্দিনকে নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরই আব্দুর রহমান দুই হাত তুলে স্বজনদের কাছে জানতে চাইলেন, 'আমার মাইনু (মাইনুদ্দিন) কই? আইলো না ক্যান, আইবো? বাবাকে ফোন করো।'
এর পরই নিজেই ইশারায় হাতের ওপর অদৃশ্য মোবাইল ফোনে নম্বর টিপে বাঁ হাত ফোনের আদলে কানে ধরলেন, বলছিলেন- 'বাবা, তুমি বলছিলা আব্বা ভালো কলেজে ভর্তি করাইয়া দিবা। তোমাকে তো কইছিলাম, ভিক্ষা কইরা অইলেও ভালো কলেজে পড়াইমু। তুমি আসো, ভর্তি করামু। মানুষের মতো মানুষ করমু তোমারে।'
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর রামপুরার তিতাস রোডের আব্দুল গণি মসজিদ এলাকার পাশের গলিতে স্বজনদের বাসার সামনে বসে এভাবেই বিলাপ করছিলেন শোকার্ত আব্দুর রহমান।মাইনুদ্দিনের মা রাশেদা বেগম বাসার নিচে বসে বিলাপ করছিলেন। স্বজনরা সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তাকে। বলছিলেন, বাবা কই গেলা তুমি। তোমার শরীরটা ছিন্নভিন্ন কইরা দিল ঘাতক বাস। তুমি কেন ওই সময় রাস্তায় গেলা। আমার পাঁজরের একপাশ ভেঙে গেল যে।'
রাশেদা বলেন, ২০০২ সালের ২৯ নভেম্বর মাইনুদ্দিনের জন্ম হয়েছিল। সেই ২৯ নভেম্বরেই আমার বুক খালি হলো।মাইনুদ্দিনের দূরসম্পর্কের বেয়াই ইমাম হোসেন সমকালকে জানান, আব্দুর রহমানের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মাইনুদ্দিন ছোট। তার বড় ভাই মনির হোসেন প্রাইভেট গাড়ির চালক। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তার বাবা-মা পালাক্রমে আব্দুল গণি মসজিদের পাশে সড়কের জামগাছের নিচে একটি চায়ের দোকান চালান। ওই দোকানের আয় এবং মনিরের বেতনে সংসার চলে তাদের। মনিরের পড়ালেখা হয়নি। তাই ছোট ছেলে মাইনুদ্দিনকে পড়ালেখা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্ন দেখতেন দরিদ্র আব্দুর রহমান। সবসময় ছেলের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দিতেন তিনি। যখন যা চাইত, সেটিই পূরণের চেষ্টা করতেন।
বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝেমধ্যে মাইনুদ্দিন ইলেকট্রিক কাজ করত বাবাকে আর্থিক সহায়তা করতে।স্বজনরা বলছিলেন, মাইনুদ্দিন যেদিন বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনের মুখে হাসিয়ে ফুটিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল, সেই দিনই ঘাতক বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিল। কাঁদিয়ে গেল স্বজনদের। তার মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছেন না তার বাবা আব্দুর রহমান ও মা রাশেদা বেগম। বিশেষ করে বাবার খুব আদরের ছিল সে। ছেলের মৃত্যুর খবর শোনামাত্র তার বাবা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সোমবার ঘটনার পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তিনি।
কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। ছেলের শোকে খাওয়া-দাওয়া করছেন না। রাতে একটুও ঘুমাননি। সারারাত বসে কাটিয়ে দেন।মাইনুদ্দিনের মৃত্যুর খবর শুনে পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও তাদের বাসায় যান। তার শ্রেণিশিক্ষক সামসুন্নাহার রানু সমকালকে বলেন, মাইনুদ্দিন খুব হাসিখুশি ছেলে ছিল। সবার সঙ্গে মিশত। তার সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল এসএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র বিতরণের সময়। সে সেদিন স্বাক্ষর করে প্রবেশপত্র নিয়ে যায়। তার সঙ্গে সেদিন কথাও হয়নি ব্যস্ততার কারণে।
শিক্ষক হিসেবে একজন ছাত্রের মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।মাইনুদ্দিনের বড় ভাই মনির হোসেন জানান, সোমবার রাতে বাসায় ঘরোয়াভাবে মাইনুদ্দিনের জন্মদিন পালনের কথা ছিল। এজন্য তিনি ভাইয়ের জন্মদিনে কেক কিনে এনেছিলেন। মাইনুদ্দিন বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে গিয়েছিল। সে বাসায় ফিরলেই কেক কাটা হতো। জন্মদিনের দিনেই পৃথিবী থেকে চলে গেল ছোট ভাইটা। মনির গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ চত্বরে বসে ছিলেন ভাইয়ের লাশ বুঝে নেওয়ার জন্য। দুপুর সাড়ে ১২টায় ময়নাতদন্ত শেষে লাশ নিয়ে তিতাস রোডের বাসার উদ্দেশে রওনা হন তারা। বাসায় ফেরেন তিনি ও তার স্বজনরা। দুপুরে আব্দুল গণি মসজিদে জানাজা হয়। এরপর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের উদ্দেশে লাশ নিয়ে রওনা হন স্বজনরা।
দুই মামলা:
এদিকে গতকাল বাসের চালকের সহকারী চান মিয়াকে সায়েদাবাদ থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গতকাল চালক ও তার সহকারীর বিরুদ্ধে মাইনুদ্দিনের মা রাশেদা বেগম বাদী হয়ে রামপুরা থানায় মামলা করেছেন। এ ছাড়া গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করে।রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম জানান, বাসচাপায় মাইনুদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনায় একটি এবং বাস পোড়ানোর ঘটনায় আরেকটি মামলা হয়েছে। চালক সোহেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত চালকের জ্ঞান ফেরেনি বলে জানান তিনি।দুর্জয়ের দাফন সম্পন্ন :নিজস্ব প্রতিবেদক (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) জানান, গতকাল বাদ এশা মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়ের মরদেহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে নানাবাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
এর আগে মঙ্গলবার বাদ মাগরিব ঢাকা থেকে তার লাশ সরাইলের হালুয়াপাড়া গ্রামে পৌঁছে। এ সময় এক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়।দুর্জয় সরাইল উপজেলার পানিশ্বর ইউনিয়নের পানিশ্বর গ্রামের আবদুর রহমানের ছেলে। প্রায় ২০ বছর আগে দুর্জয়ের বাবা বাড়িঘর বিক্রি করে পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে যান।দুর্জয়ের খালাতো ভাই খোরশেদ আলম বলেন, দুর্জয়ের বাবা আবদুর রহমান প্রায় ২০ বছর আগে বসতবাড়ি বিক্রি করে পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে যান। সেখানে তিনি একটি চায়ের দোকান চালাতেন।