সরকারি নিবন্ধনে কেন রাজী নন কওমী মাদরাসার নেতারা?

সরকারি নিবন্ধনে কেন রাজী নন কওমী মাদরাসার নেতারা?

কওমী মাদরাসাগুলোকে সরকারের নিবন্ধনের আওতায় আনা এবং এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি সমন্বিত নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। তবে কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারের কাছে নিবন্ধনের প্রস্তাবে রাজি নয় বেসরকারি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের নেতৃত্ব।

তারা বলেছেন, নিবন্ধনের আওতায় এনে সরকারের তদারকি বাড়ানো হলে কওমী মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা থাকবে না। সেজন্য তারা সরকারের কাছে নিবন্ধনে রাজি নন।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা যাতে কর্মক্ষেত্রের জন্য যোগ্য এবং দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠে, সেজন্য এই শিক্ষা কার্যক্রমকে যুগোপযোগী করার বিষয় সরকার বিবেচনা করছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও কওমী মাদরাসার কার্যক্রম খতিয়ে দেখে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সরকার কী করতে চাচ্ছে
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের বোর্ড এবং সরকারের কোনো পর্যায়ের প্রশাসনের কোনো অনুমতির প্রয়োজন হয় না। এছাড়া সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম বা নীতিমালাও নেই।

সরকারের একটি কমিটি খতিয়ে দেখেছে যে, শহর থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত অনেক কওমী মাদরাসা গড়ে উঠেছে কোনোভাবে একটি ঘর ভাড়া করে। যেখানে শিক্ষার পরিবেশ নেই।

এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকার কওমী মাদরাসার সর্বোচ্চ দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিকে মাস্টার্স এর মর্যাদা দিয়েছে। এর ভিত্তিতে কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন চাকরিতে প্রবেশের বা কর্মক্ষেত্র খুঁজে নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

সে কারণে এই শিক্ষাকে একটা নিয়মের মধ্যে আনতে নিবন্ধনের ব্যবস্থাসহ একটি সমন্বিত নীতিমালার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

সাধারণ শিক্ষা, ইংরেজী মাধ্যমসহ সব ধরনের শিক্ষার জন্য সরকার একটি শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করেছে।

সেই খসড়ায় কওমী মাদরাসা শিক্ষা নিয়েও সুনির্দিষ্ট বিধান রাখা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বিবিসিকে বলেছেন, দেশের সার্বিকভাবে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যই কিছু নিয়ম থাকা প্রয়োজন।

সরকারি নিবন্ধনে রাজি নয় কেন
কওমী মাদ্রাসাগুলোর সবচেয়ে বড় শিক্ষা বোর্ড বেফাক এর সভাপতি মাহমুদুল হাসান বিবিসিকে বলেছেন, তাদের সাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আলোচনায় বসে সরকারের কাছে মাদরাসার নিবন্ধনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তারা সেই প্রস্তাবে রাজি হননি।

তিনি মনে করেন, তারা তাদের অবস্থানের ব্যাপারে সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন।

তিনি উল্লেখ করেছেন, তাদের স্বকীয়তা রক্ষায় সরকার কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না বলে জানানো হয়েছে এবং সরকারের কাছে নিবন্ধনের ব্যাপারে তাদের আর কিছু বলা হয়নি।

কিন্তু তাদের এমন অবস্থানের পেছনে যুক্তি কী -এই প্রশ্নে মাহমুদুল হাসান বলেন, সরকারের সরাসরি নিবন্ধনের ব্যবস্থা না থাকলেও কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পর তাদের বেসরকারি মাদরাসা বোর্ডের কাছে নিবন্ধন করতে হয়।

‘বেসরকারিভাবে বেফাকসহ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড যেগুলো রয়েছে, কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পর তাদের কাছে নিবন্ধন করতে হয়। এক বছর পর পর এই নিবন্ধনের তালিকাসহ প্রতিবেদন আমরা বেফাকের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে পেশ করি’ বলেন বেফাক এর সভাপতি মাহমুদুল হাসান।

তিনি দাবি করেন, কোনো কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পর তার নিবন্ধনের জন্য মাদরাসা বোর্ডের কাছে আবেদন করা হলে, তখন প্রতিষ্ঠাতা ও অর্থের যোগানের ব্যাপারে তথ্য নেয়া হয়। এছাড়া তাদের মাদরাসা বোর্ড আবেদনকারী মাদরাসা পরিদর্শন করে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করে এবং এরপর তারা নিবন্ধন দিয়ে থাকেন।

নিবন্ধনের প্রশ্নে সরকারি গেজেট
কওমী মাদরাসাগুলোর বেসরকারি শিক্ষা বোর্ড রয়েছে ছয়টি। এর মধ্যে বেফাক সবচেয়ে বড় বোর্ড।

এই বেফাকের আরেকজন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৮ সালে যখন দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিকে মাস্টার্স সমমানের মর্যাদা দিয়েছে, তখন মাদরাসার ছয়টি বেসরকারি বোর্ডের নেতৃত্বকে সমন্বয় করে আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামি'আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ নামের সর্বোচ্চ একটি বোর্ড গঠন করে দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।

বেফাক কর্মকর্তা আরো বলেছেন, এ ব্যাপারে সরকারি গেজেট আছে এবং ২০১৮ সালেই সংসদে কওমী মাদরাসার স্বকীয়তা এবং স্বাধীনতা দিয়ে আইনও পাস করা হয়েছে। তাতে সর্বোচ্চ বোর্ডকেই নিবন্ধনের দায়িত্ব দেয়া হইছে।

কারিকুলাম নিয়ে সরকারের ভাবনা
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বিবিসিকে বলেছেন, সরকার কওমী মাদরাসার স্বকীয়তা এবং সেই আইনকে সম্মান করে।

তবে তিনি বলেন, সরকার কোনো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায় না। সরকার চাচ্ছে, এই শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে।

‘আমাদের জাতীয় পাঠক্রম আছে। সেই পাঠক্রম অনুযায়ী একটা বয়সসীমা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের যে শিক্ষা লাভ করতে হয়, কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও যাতে সেই জাতীয় পাঠক্রমের শিক্ষা নিয়ে কর্মযোগ্য বা কর্মদক্ষ হয়-সেজন্য আমরা তাদের সাথে একসাথে কাজ করবো’ বলেন মহিবুল হাসান চৌধুরী।

তিনি আরো বলেন, ‘শুধু ধর্মতত্ত্বের ওপর শিক্ষা নিয়ে তাদের কিন্তু কর্মযোগ্যতা হয় না। তার ফলে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী সমস্যায় পড়ে যাচ্ছে।’

‘তাদের কর্মদক্ষতা না থাকায় তারা কোথাও চাকরি পাচ্ছে না। সেজন্যই আমরা তাদের শিক্ষা নিয়ে একসাথে কাজ করছি। এখানে নিয়ন্ত্রণ বা তদারকির কিছু নেই’ বলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী।

সরকার চাচ্ছে, দশম শ্রেণির সমমর্যাদা পর্যন্ত কওমী মাদরাসার শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি এবং অংক যেন পড়ানো হয়।

এখন কী পড়ানো হচ্ছে
বেফাকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ১৯ হাজারের বেশি কওমী মাদরাসায় ২০ লাখের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে।

ঢাকার যাত্রাবাড়ি এলাকার একটি মহিলা মাদ্রাসার একজন শিক্ষক আয়েশা আকতার বিবিসিকে বলেছেন, তার মাদরাসায় প্রাথমিক থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত সাড়ে চার শ’ জনের মতো শিক্ষার্থী আছে।

এই শিক্ষক বলেছেন, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, অংক পড়ানো হয়। এরপর ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি অংকের সাথে ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান বিষয় রয়েছে। এছাড়া ধর্মীয় বিষয় পড়তে হয়।

আয়েশা আকতার জানিয়েছেন, নবম শ্রেণি থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত কোরআন হাদিসের আলোকে আরবিতে পড়ানো হয়। এসব পর্যায়ে ইতিহাস পড়ানো হয় ভারতের মাদরাসা দারুল উলুম দেওবন্দের।

তিনি জানিয়েছেন, এই কারিকুলাম বা সিলেবাস তাদের বোর্ড বেফাক ঠিক করে দেয়।

ভিন্নমত
এখন সরকার যে এই শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার কথা বলছে, তা নিয়ে বেফাকসহ বেসরকারি মাদরাসা বোর্ডগুলোর নেতৃত্বের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে।

বেফাকের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, কওমী মাদরাসায় দশম শ্রেণির সমমর্যাদা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদেরও বাংলা ইংরেজী এবং বাংলাদেশের ইতিহাস পড়ানোর উদ্যোগ তারা নেবেন।

বেফাকেরই আরেকজন কর্মকর্তা বলেছেন, কওমী মাদরাসা ভারতের দেওবন্দকে অনুসরণ করে। সেজন্য দেওবন্দের সিলেবাস অনুসরণ করেই বাংলাদেশেও কওমী মাদরাসার সিলেবাস নির্ধারণ করা হয়।

এখানে পরিবর্তনের সুযোগ নেই বলে তারা অনেক আগেই সরকারকে লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছেন বলে বেফাকের ওই কর্মকর্তা জানান।

উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী অবশ্য বলেছেন, সরকার যে পদক্ষেপ নেবে, তা কওমী মাদরাসা বোর্ডের সাথে আলোচনা করেই ঠিক করবে। সূত্র : বিবিসি

এমজে/