একটা মানুষ মারতে কয়টা গুলি করা লাগে?

একটা মানুষ মারতে কয়টা গুলি করা লাগে?

‘আচ্ছা, একটা মানুষকে মারতে কয়টা গুলি করা লাগে, আপনারাই বলেন।’ অশ্রুভেজা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন মুনিয়া আক্তার। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী নুরুজ্জামান জনি খিলগাঁও থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শুধু তাঁর বুকেই ১৬টি গুলি করা হইছে। এরপর তাঁর পায়ে, ঘাড়ে গুলি করা হইছে। আপনারাই বলেন, একটা মানুষ মারতে কয়টা গুলি করা লাগে?’

সাত বছর আগে নুরুজ্জামান জনিকে হত্যা করা হয়েছিল। বিচার না পাওয়ার কথা জানিয়ে আজ শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার লেডিস ক্লাবে এক ইফতার অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলেন তাঁর স্ত্রী মুনিয়া আক্তার। গুম ও খুন হওয়া ৪৮ ব্যক্তির পরিবারের স্বজনদের নিয়ে এই ইফতার অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার আয়োজন করে জাতীয়তাবাদী কৃষক দল।

এ সময় মুনিয়া বলেন, ‘আমি তখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। আমার বাচ্চার বয়স এখন সাত বছর চলছে। সে এখন ক্লাস ওয়ানে পড়ে। এখন আমার বাচ্চাকে বাবার নাম লিখতে লেট (মৃত) নুরুজ্জামান লিখতে হয়। বাচ্চা আমাকে প্রশ্ন করে, মামণি আমার ফ্রেন্ড আমাকে কোশ্চেন করেছে, ওর বাবার নামের আগে লেট নেই, আমার বাবার নামের আগে লেট কেন?’

‘এই দেশে বাবা-ভাইয়ের হত্যার বিচার হচ্ছে, আমরা কী বিচার পাব না?’ মুনিয়া আক্তার আক্ষেপ করে বলেন।

অনুষ্ঠানে কথা বলেন, প্রায় ১০ বছর আগে এই এপ্রিল মাসে গুম হওয়া বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসীনা রুশদীর। তিনি বলেন, ‘এই ১০ বছরে আমরা বহুবার, বহু জায়গায়, বহু মাধ্যমে কথা বলেছি, বিষয়টি নিয়ে কথা বলাটা খুবই কষ্টের।’

তাহসীনা রুশদীর বলেন, ‘বর্তমান সরকারের কাছে আসলে আমাদের কোনো দাবি নেই। যারা নিজেরাই খুনের সঙ্গে জড়িত, তারা কখনোই এর বিচার করবে না। গুম কী জিনিস, তারা সেটা স্বীকার করে না। কারণ, এটা তাদের সৃষ্টি। প্রত্যাশা করি, আগামীতে আমরা নিশ্চয়ই এই গুম ও খুনের বিচার পাব।’

অনুষ্ঠানে গুমের শিকার ছাত্রদল নেতা মাহফুজুর রহমানের (সোহেল) মেয়ে সাফা, নুরুল আলম নুরের মেয়ে উম্মে হাবিবা, সাজেদুল ইসলামের বোন আফরোজা ইসলামসহ অনেকে নিখোঁজ বাবা, ভাই ও সন্তানের জন্য আকুতি জানান। তাঁরা সবাই গুম হওয়া ব্যক্তির সন্ধান চান, ফিরে পেতে চান হারানো স্বজনদের।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী, গুম চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধ। এই কাজ আওয়ামী লীগের সরকার গত কয়েক বছর ধরে করেছে। যারা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছে, তাদের গুম ও হত্যা করেছে সরকার।

মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে আজকে যে বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলো এসেছে, এরা গত ৭, ৮, ৯, ১০ বছর ধরে তাদের বাবাকে খুঁজছে। এই রকম প্রায় ছয় শ পরিবার আছে, যে পরিবারগুলো তাদের পুত্রকে, স্বামীকে, অন্যরা পিতাকে খুঁজছে। কিন্তু তাদের পাচ্ছে না। এটা প্রমাণিত সত্য যে এদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং এর পর থেকে তারা গুম হয়ে গেছে। যে কারণে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এই র‍্যাবের ওপর এসেছে, অনেক কর্মকর্তার ওপর এসেছে।’

বিএনপির মহাসচিব আরও বলেন, ‘রমজানের দিনে আমাদের কথাগুলো বলার ইচ্ছা হয় না। তারপরও বলতে হয়, আমরা যদি এই সরকারকে সরাতে না পারি, আওয়ামী লীগকে যদি সরাতে না পারি, তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকবে না। আজকে সমস্ত নির্যাতন-নিপীড়ন, গুম-খুন বন্ধ করতে হলে সত্যিকার অর্থে জনগণের একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেটা এ দেশের মানুষকে আন্দোলন এবং গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে করতে হবে।’

অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, একদিন এঁদের (গুম-খুনের শিকার হওয়া ব্যক্তি) প্রতি করা অন্যায়ের বিচার হবে। এই সরকারের অবসান হবে। খুব বেশি দিন লাগবে না, যত অত্যাচার করেছে, একটার পর একটা ঘটনার মধ্য দিয়ে তারা ধরা পড়ছে। এটা আরও বেশি প্রকাশিত হবে।

সরকারের সমালোচনা করে মান্না বলেন, ‘এত বড় বড় সমস্ত প্রকল্প দেখায়, ব্রিজ দেখায়, ফ্লাইওভার দেখায়, পদ্মা ব্রিজ দেখায়, এখন দেখা যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এক বছর পর থেকে যে সুদ দিতে হবে, সেই সুদের টাকা পর্যন্ত নেই। দেখা যাচ্ছে, প্রত্যেক বছর বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ করার মতো টাকা দিনের পর দিন বেড়ে যাচ্ছে। সব দিক থেকে ধাওয়া খাওয়ার পরে এমন পরিস্থিতিতে এ সরকার যাবে যে নিজের জায়গা থেকে একদম সামনে পেছনে, ডানে-বাঁয়ে কোনো দিকে যাওয়ার সুযোগ পাবে না।’

কৃষক দলের সভাপতি হাসান জাফিরের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, আমানউল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, হাবিব উন নবী খান, খায়রুল কবির, শহীদউদ্দিন চৌধুরী, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, ডেমোক্রেটিক লীগের সাইফুদ্দিন মনি প্রমুখ।