তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হবে না: বিএনপি মহাসচিব

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হবে না: বিএনপি মহাসচিব

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ দেশের মানুষের মনের দাবি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে আর নির্বাচন হবে না।’

তিনি বলেন, ‘বিগত ২ নির্বাচনে আপনারা মানুষকে মিথ্যা কথা বলে ভুল বুঝিয়ে নির্বাচন নির্বাচন খেলা করে ক্ষমতায় চলে গেছেন। এই বার আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এইবার দেশে আর কোনো নির্বাচন হবে না, যতক্ষণ নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার না দেওয়া হবে।’

শনিবার বিকেলে ফরিদপুরের কোমরপুর আবদুল আজিজ ইনস্টিটিউশন মাঠে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে এ সব কথা বলেন তিনি।

আওয়ামী লীগের দুর্গ বলে পরিচিত ফরিদপুরে শেষ পর্যন্ত বিএনপি যে সমাবেশ করেছে সেখানে পরিবহন ধর্মঘট, নানান রকম প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে দলের লাখো নেতা-কর্মী যোগ দিয়েছেন।

ফরিদপুর শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে কোমরপুর আব্দুল আজিজ ইন্সটিটিউশন মাঠে অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির এই গণ-সমাবেশ। অনেকে এই ছয় কিলোমিটার হেঁটে সমাবেশ স্থলে যোগ দেন। ফরিদপুর শহরের মোড়ে মোড়ে পুলিশের সতর্ক অবস্থান দেখা গিয়েছে।

বিএনপির এর আগের গণ-সমাবেশগুলোর মতো এবার ফরিদপুরেও আগের দিন থেকে গণ-পরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে ফরিদপুর শহর কার্যত কার্যত সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শহরে ইন্টারনেট সংযোগও কাজ করছিল না।

বিএনপি নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, তাদের সমাবেশ ঠেকাতেই পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে।

সরকারকে গণতন্ত্র হত্যাকারী ও রিজার্ভ চোর আখ্যায়িত করে গণসমাবেশ থেকে বিএনপি নেতারা বলেছেন, ভোট ছাড়াই ক্ষমতায় এসে সরকার দেশের সকল গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছে। মেগাপ্রকল্পের নামে মেগাদুর্নীতির মাধ্যমে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে। দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে দিয়েছে। গত এক বছরেই সরকার দশ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে। দেশের গণতন্ত্র ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ উদ্ধারে এ সরকারের পতন জরুরি।

সমাবেশে আগত নেতাকর্মীরা বলেন, “ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেসব সমাবেশ করছে সেখানে তারা প্রশাসনের পূর্ণ সহযোগিতা পাচ্ছে। শত শত বাসে করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাদের নেতাকর্মীদের আনা হচ্ছে। অন্যদিকে বিএনপি যাতে সমাবেশ সফল করতে না পারে সেজন্য পরিবহন মালিকদের দিয়ে সরকার ধর্মঘট করাচ্ছে।”

বাস ধর্মঘট থাকায় দু’দিন আগ থেকেই নেতাকর্মীরা ফরিদপুর শহরে ভিড় করেন। তাদের অধিকাংশ সমাবেশের মাঠেই রাত-যাপন করেন। সেখানেই চলে খাওয়া-দাওয়া।

ফরিদপুরকে বিএনপি তাদের সাংগঠনিক বিভাগ হিসেবে বিবেচনা করে। মূলত ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ি এই ৫টি জেলা থেকেই বেশিরভাগ নেতাকর্মী সমাবেশ স্থলে ভিড় করেন। এসব জেলায় আওয়ামী লীগের শক্ত অবস্থান থাকলেও বিএনপির সমাবেশে জমায়েত ছিল চোখে পড়ার মতো।

এর আগে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর ও বরিশালে সমাবেশ করেছিল বিএনপি।

ফখরুল বলেন, ‘আপনারা সংবিধানের কথা বলেন, বলেন সংবিধানে যেমনটি আছে তেমনটি হবে। কী আছে সংবিধানে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তো সংবিধানে ছিল, ১৯৯০ সালের পরে ৪-৫টি নির্বাচন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। তখন সবাই ভোট দিতে পেরেছিল। সংবিধানকে আওয়ামী লীগ ধ্বংস করেছে। একবার করেছিল ১৯৭৫ সালে। সবগুলো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে দিয়ে, সবগুলো পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে বাকশাল চালু করেছিল।’

তিনি বলেন, ‘জনগণের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আজকে দেশের আলেম-ওলামাদেরকে পর্যন্ত তারা হয়রানি করছে। মিথ্যা মামলায় আসামি করে তাদেরকে জেলে পাঠাচ্ছে। তাদেরকে জামিনও দিচ্ছে না।’

ফখরুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বলেছে- টাকা কি আমরা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছি? টাকা আপনারা চিবিয়ে খাননি, আপনারা গিলে খেয়ে ফেলেছেন। আপনারা রিজার্ভ গিলে খেয়ে ফেলেছেন।’

বর্তমান সরকারের আমলে গত এক যুগে ১০ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘দেশের সম্পদ লুট করে তারা বিদেশে পাচার করছে। সরকার কোথায় চুরি করেনি? মেগা প্রজেক্ট থেকে শুরু করে বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা পর্যন্ত চুরি করেছে।’

মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে, দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাদের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’

বিকেল ৪টা ২৮ মিনিটে শুরু করে প্রায় আধা ঘণ্টা বক্তব্য দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা এই বাংলাদেশ চাইনি। আমরা চাইনি আমাদের ছেলেরা পড়াশোনা শেষ করে হকারি করবে, মোটরসাইকেল চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করবে, ভালো চাকরির ব্যবস্থা তাদের হবে না।’ তিনি আরও বলেন, দেশের ৪২ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বলা হয়েছিল, ১০ টাকা সের চাল খাওয়ানো হবে, ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়া হবে, বিনা মূল্যে সার দেওয়া হবে, তার কিছুই হয়নি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নাকি গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। এটা ভূতের মুখে রাম নাম। প্রশ্ন করি, আপনাদের কাছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী? আপনাদের গণতন্ত্র মানে কি এই যে অন্য কাউকে কিছু বলতে দেব না?’

আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘তারা মনে করে এ দেশ তাদের বাবার দেশ, দেশের আর সকলে চাকরবাকর। কিন্তু এ অবস্থা আর চলবে না, মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাবে না।’

আওয়ামী লীগের উদ্দেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, একনায়কতন্ত্রের যেভাবে পতন হয়, তা আপনারা সহ্য করতে পারবেন না। আমাদের দাবি, চুরির টাকা যা নিয়ে গেছেন, তা ফেরত আনেন। দেশে দুর্ভিক্ষ হবে না। ৪৭ সালে একটা হয়েছিল সেটা অন্য কারণে। রাজনৈতিক কারণে নয়। এখন যদি হয় রাজনৈতিক কারণে হবে।

‘গলা টিপে ধরার দিন শেষ, এখন খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের বাংলাদেশ’উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সরকারের অধীনে আপনারা ভোট দিতে পারবেন না। আমরা লড়াই করে ভোটের অধিকার আদায় করবো। নয় হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে পাচার করে দিয়ে, ডাল কেনার টাকা, চাল কেনার টাকা নাই, শুধু নাই নাই। শুধু আছে আওয়ামী লীগ। তাও আবার জনসমর্থনহীন আওয়ামী লীগ।

মির্জা আব্বাস বলেন, এইভাবে চলতে থাকলে সরকারের সমর্থন কমে যাবে, গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে। আরে সরকারের সমর্থন যদি থাকতো তাহলে তো আমাদের সমাবেশে বাধা দিতো না। সুযোগ পেলে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমানকে জানাবো, আপনাদের ভালোবাসার কথা। ফরিদপুরবাসীকে ধন্যবাদ জানাই, আপনারা আওয়ামী লীগকে দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ফরিদপুর জেগেছে, ফরিদপুর বার্তা দিয়েছে। এই মাঠের বাইরেও একটি বিশাল অংশ জনতা রয়েছে। আজকের মহাসমাবেশে মানুষ উজ্জীবিত হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশালে সমাবেশ হয়েছে। ফরিদপুর থেকে আজকে বার্তা দিয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা আগামীদিনে আন্দোলন কেমন হবে- এর বার্তা দিয়েছে।

আমীর খসরু বলেন আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। নির্বাচনের ফলাফল কি হবে তার বার্তা আজকে আপনারা (বিএনপি নেতাকর্মীরা) দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ অনেক চেষ্টা করেছে, বাধা নিয়ে এই সমাবেশ ঠেকাতে। বাস, টেম্পু সব বন্ধ করেও মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ার ঠেকাতে পারেনি। ৬ জন সহকর্মী জীবন দিয়েছে ইতোমধ্যে। ৩৫ লাখ বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। তারপরও এখানে এসেছেন আপনারা।

বিএনপির ফরিদপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেছেন, যত বাধা আসুক না কেন, গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে হবে। সেদিন খালেদা জিয়া মুক্ত হবে। তারেক রহমান দেশে এসে নেতৃত্ব দিবে। এ সমাবেশ প্রমাণ করে ফরিদপুরের প্রতিটি বালুকণা বিএনপির দখলে। ২০১৮ সালে যখন ব্যালট ছিনতাই হয়েছিল, সেই রাতে টুঙ্গিপাড়াতেও ব্যালট ছিনতাই করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে! ফরিদপুরে আর আওয়ামী লীগের কোনো ঘাঁটি নেই। এটি এখন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দখলে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেছেন, ফরিদপুর থেকেই গণসমাবেশের নতুন যাত্রা শুরু। সবাই জানত এই ফরিদপুর নাকি কার ঘাঁটি, তাদের বাপ-দাদার পৈতৃক সম্পত্তি। আপনারা প্রমাণ করে দিয়েছেন এই ফরিদপুর বিএনপি, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানের ঘাঁটি। এই ফরিদপুর থেকেই গণসমাবেশের নতুন যাত্রা শুরু হবে। আগামী ১০ ডিসেম্বব ঢাকায় সমাবেশের মধ্য নিয়ে এই নতুন যাত্রা শেষ হবে

আগামী ৩১ ডিসেম্বর সরকারের শেষ সময় এমন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছেন, জনগণ এই সরকারের এখনই পদত্যাগ চায়। ১৪ বছর দেশ চালাইছেন, অনেক উন্নয়ন করেছেন। এখন দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন। আমাদের দুর্ভিক্ষের দরকার নেই। দাবি করছি, আগামী ৩১ ডিসেম্বর লাস্ট টাইম। দয়া করে ২০২২ সালের মধ্যে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেন।

জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হেলেন জেরিন খান বলেছেন, শেখ হাসিনা দুটি ফন্দি করছে। একটি হলো-দুর্ভিক্ষের কথা বলে দেশের নির্বাচন পিছিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আমরা সেটা হতে দেব না। অপরটি হলো আওয়ামী লীগের গুন্ডাবাহিনী দিয়ে দেশে জ্বালাও পোড়াও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে বিএনপির সমাবেশ নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে

হেলেন জেরিন খান বলেন, ফরিদপুর শেখ হাসিনার নিজের শহর। ফরিদপুর তোমার নিজের বিভাগ। তুমি অনেক চেষ্টা করেছ সমাবেশে বাধা দিতে কিন্তু কেউ শুনেনি। তোমাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে লাখ লাখ মানুষ সমাবেশ হাজির হয়েছে। এ সমাবেশ প্রমাণ করেছে দেশের মানুষ খালেদা জিয়ার কথা শুনে, তারেক রহমানের কথায় দেশ চলে। মির্জা ফখরুলের কথায় মানুষ চলে।

গণসমাবেশের সভাপতিত্ব করেন ফরিদপুর নগর বিএনপির আহ্বায়ক এ এস এম কাইয়ুম। সেখানে বিএনপির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা বক্তব্য দেন।