জাতিসংঘের মানব পাচার গবেষণা

পাচার বাংলাদেশিদের ৫১% জীবিকার কারণে

পাচার বাংলাদেশিদের ৫১% জীবিকার কারণে

বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার হওয়ার মোট আটটি ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে জাতিসংঘ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে তুলে ধরা হয়েছে। অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে বাংলাদেশের অগ্রগতি হলেও পাচার হওয়া মানুষের ৫১ শতাংশই জীবিকার কারণে পাচারের শিকার হচ্ছেন। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয় ইউএনওডিসির এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ সরকারের পরামর্শে প্রথমবারের মতো মানব পাচার নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে এ গবেষণা করে সংস্থাটি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে এ গবেষণাপত্র প্রকাশ করা হয়। অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও বাকি ঝুঁকিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ভেঙে যাওয়া পরিবারের শিশু (২০ শতাংশ), প্রতারক সঙ্গী (১৩ শতাংশ), মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী (১০ শতাংশ), অভিবাসন জটিলতা (১০ শতাংশ), যেসব শিশু মা-বাবার পর্যাপ্ত যত্ন পায় না (৯ শতাংশ), স্বল্পশিক্ষা বা বিদেশি ভাষা না জানা (৬ শতাংশ) এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী (৩ শতাংশ)।অর্থনৈতিক কারণটিতে বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের অন্যতম ঝুঁকি বিবেচনায় দরিদ্রতা এবং পর্যাপ্ত আয়ের সুযোগ না থাকাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশের মানুষ শুধু মানব পাচারের শিকারই হচ্ছেন না, বরং ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও যোগ দিচ্ছেন। আর এ থেকে উত্তরণের লোভ দেখিয়ে পাচারকারীরা দুর্বল মানুষগুলোর সরলতার সুযোগ নিচ্ছে। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে এবং দরিদ্র ও অতিদরিদ্র কমেছে। তবে গ্রামের অনেক মানুষই দরিদ্রই থেকে গেছে। আবার আয়ের জন্য কাজে যোগ দিতেও মরিয়া মানুষ। বাংলাদেশে আয়ের সুযোগ কম থাকায় বিদেশে ভালো আয় ও কাজের নিশ্চয়তার প্রতিশ্রুতিতে মানুষ উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্র্যাচ্যের দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। আর দেশগুলোতে বৈধভাবে পাঠানোর পর পাচারকারীরা তাঁদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না। সেখানে পৌঁছানোর পর পাচারকারী চক্রের মাধ্যমে অন্য দেশে পাচারের ঝুঁকি তৈরি হয়ে থাকে। ২০১৮ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, একজনকে বিক্রি করার মাধ্যমে পাচারকারীরা ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকে।

২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি মানব পাচার হয়েছে বাহরাইনে (২৭ শতাংশ)। এর পর সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে থাইল্যান্ড (১৭ শতাংশ), মালয়েশিয়া (১৫ শতাংশ) এবং ভারতে (১০ শতাংশ)। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য গন্তব্যেও পাচারের শিকার হয়েছেন বাংলাদেশিরা। দেশ থেকে পাচারের রুট হিসেবে ঢাকা, কাঠমান্ডু ও ইস্তাম্বুল এবং ঢাকা, কলকাতা, মুম্বাই, করাচি ও দুবাইয়ের তথ্য গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে।বাংলাদেশ থেকে পুরুষ, নারী ও শিশুদের পাচার করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ৩৮২ পুরুষ, ২৩৩ নারী ও ১৫৫ শিশুকে পাচার হয়েছেন। ২০১৮ সালে পাচার হয়েছেন ২১২ পুরুষ, ২১০ নারী ও ৮০ শিশু। তবে এর বাইরেও অনেক রয়েছে। পাচার হওয়া পুরুষদের জোরপূর্বক শ্রমে বাধ্য করা এবং নারীদের যৌন নিপীড়ন করা হয়।

বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ফেনী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারীসহ দেশের মোট ১৫টি জেলা বাদে বাকি সব জেলার মানুষ পাচারের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ঝিনাইদহ, নড়াইল, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং হবিগঞ্জ থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ পাচার হয়। তবে বাংলাদেশকে পাচারের রুট হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকেও বাংলাদেশে এনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়। প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে সীমান্তপথ দিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমার হয়ে নারী ও মেয়ে শিশুদের পতিতাবৃত্তির জন্য চীনে পাচার করা হয়। এ ক্ষেত্রে পাচারকারীরা সমুদ্রপথ ব্যবহার করে। সমুদ্রপথ মূলত জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ব্যবহার করা হয়।

বাংলাদেশ থেকে শুধু বিদেশেই নয়, অনেক ক্ষেত্রে গ্রাম থেকে শহরে পাচারের ঘটনা ঘটে। জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য পরিবেশগত কারণে এমনটি হয়ে থাকে।বাংলাদেশে মানব পাচার রোধে ২০১২ সালে মানব পাচার বিরোধী আইন করা হয়। এর পর থেকে মানব পাচার নিয়ে মামলার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। তবে সে অনুযায়ী দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ২০১৮ সালে মানব পাচারের মামলায় ৬৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর এর মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র চারজনের। ২০১৯ সালে ১৯৯ জনের গ্রেপ্তারের বিপরীতে ৯ জনের সাজা এবং ২০২০ সালে ৩৭৩ জনের গ্রেপ্তারের বিপরীতে একজনের সাজা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত প্রমাণ না থাকায় মামলাগুলো এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না।প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান বলেন, মানব পাচরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন পাচারের পরে শুধু শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনই করা হয় না, কেটে নেওয়া হয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও, যা অমানবিক ও ফৌজদারি অপরাধ। এগুলো রুখতে আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে।

ইউএনওডিসির দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রতিনিধি মার্কো টেক্সেইরা বলেছেন, অনলাইনে মানব পাচারের নিয়োগ এবং সাইবার ক্রাইমের মাধ্যমে মানব পাচারের মতো বিষয়গুলো উঠে এসেছে প্রতিবেদনটিতে। করোনা মহামারিতে এই পরিস্থিতি বেড়েছে। যেখানে মানব পাচারকারীরা আরও প্রযুক্তি সচেতন হয়ে উঠছে। তবে সফলভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা মানব পাচারকারীদের শনাক্ত, তদন্ত এবং বিচার করতে পারি।

বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুয়েন লুইস বলেছেন, আমাদের অবশ্যই টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিক্রিয়াসহ দারিদ্র্য এবং পদ্ধতিগত বৈষম্যকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ করা দরকার।প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে আইওএম বাংলাদেশের মিশন প্রধান এবং বাংলাদেশ ইউএন নেটওয়ার্ক অন মাইগ্রেশন (বিডিইউএনএনএম) সমন্বয়ক আবদুসাত্তর এসোয়েভ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খায়রুল আলম, ঢাকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের হেড অব কো-অপারেশন মৌরিজিও সিয়ান, ঢাকায় কানাডার হাইকমিশনের কাউন্সিলর (রাজনৈতিক ও পাবলিক অ্যাফেয়ার্স) ব্র্যাডলি কোটস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অনু বিভাগের মহাপরিচালক তৌফিক ইসলাম শাতিলসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।