গ্যাস নেই, তবু একের পর এক প্রকল্প

গ্যাস নেই, তবু একের পর এক প্রকল্প

বাস্তবতা অনুধাবন না করেই খুলনা-যশোর অঞ্চলে গ্যাস দিতে প্রায় ১২শ কোটি টাকা খরচায় নির্মাণ করা হয়েছিল সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামো। পরে গ্যাস সংকটের মুখে ওই প্রকল্প বাতিল করে সরকার। এই বিপুল বিনিয়োগ এখন পড়ে আছে মাটির নিচে। ঋণ করে নেওয়া এই অর্থের ঘানি টানছে সংশ্নিষ্ট কোম্পানিগুলো। কাজে না লাগলেও সঞ্চালন ও বিতরণ পর্যায়ে এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় ও অপরিকল্পিত প্রকল্প এখনও থেমে নেই।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস সংকটে কাজে লাগবে না জেনেও এসব প্রকল্প নেওয়া হয় মূলত রাজনৈতিক কারণে। তাঁরা বলছেন, বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৩৮০ কোটি ঘনফুট। পেট্রোবাংলা দিচ্ছে ২৭৪ কোটি ঘনফুট। বছরে ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার গ্যাস আমদানি করেও শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি মেটানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে নতুন এলাকায় গ্যাস দেওয়ার প্রকল্প পুরোপুরি অপচয়। অযাচিত এসব খরচ পরে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের পকেট থেকেই তুলে নেওয়া হবে। সর্বশেষ গত ২৮ জানুয়ারি গ্যাসের দাম গ্রাহকভেদে ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম সমকালকে বলেন, দেশের অধিকাংশ এলাকায় গ্যাস পাইপলাইন বসানো হয় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে। আদতে এসব প্রকল্পের প্রয়োজন আছে কিনা, সে জন্য আর্থিক ও কারিগরি সমীক্ষা করা হয় না। রাজশাহীতে গ্যাস নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। খুলনায় হাজার কোটি টাকা খরচ করে লাইন ফেলে রাখা হয়েছে। এখন উত্তরাঞ্চলে গ্যাস নিতে আবার লাইন করা হচ্ছে, যা কোনো কাজে আসবে না। তিনি বলেন, সরকার আবাসিকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছে, তবু বিতরণ অবকাঠানো উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প কেন নেওয়া হচ্ছে- এর জবাব নেই।

লোকসানে জিটিসিএল, চায় ক্যাপাসিটি চার্জ :অপরিকল্পতিভাবে নেওয়া গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি-জিটিসিএলের ৯ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার পাইপলাইন এখন পূর্ণসক্ষমতায় ব্যবহূত হচ্ছে না। আরও ৩ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সংস্থাটি। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকায় দেশের উত্তরাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহে ১৫০ কিলোমিটার বগুড়া-রংপুর-সৈয়দপুর সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ঢাকা ও এর আশপাশের শিল্পকারখানাই গ্যাস পাচ্ছে না, সেখানে উত্তরাঞ্চলে গ্যাস দেওয়া পাইপলাইন নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। ৮২৩ কোটি টাকায় ধনুয়া-এলেঙ্গা-নকলা পাইপলাইন নির্মিত হয়েছে। গ্যাস সংকটে এটিও খুব বেশি কাজে লাগবে না বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।

অপ্রয়োজনীয় এসব প্রকল্প খরচ মেটাতে লাভজনক প্রতিষ্ঠান জিটিসিএল এখন লোকসানে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির নিট লোকসান হয়েছে ২১৭ কোটি টাকা। জ্বালানি বিভাগে উপস্থাপন করা জিটিসিএলের এক প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, পাইপলাইন নির্মাণে ৯ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। উৎপাদিত ও আমদানি করা গ্যাসের স্বল্পতার কারণে এই অবকাঠামো পূর্ণসক্ষমতায় ব্যবহূত হচ্ছে না। এই বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারের জন্য ৪৮৪ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ প্রয়োজন, প্রতি ঘনমিটারে যার পরিমাণ ০.২৩১৪ টাকা; যা সঞ্চালন মাশুলের সঙ্গে যোগ করতে চায় জিটিসিএল।

লোকসান কমাতে গ্যাসের সঞ্চালন চার্জ (মাশুল) একলাফে প্রায় পাঁচ গুণ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে জিটিসিএল। কোম্পানিটি বর্তমান মাশুল প্রতি ঘনমিটারে ০.৪৭৭৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২.০৪৬৯ টাকা করার প্রস্তাব করেছে। এ সংক্রান্ত আবেদন জ্বালানি বিভাগে জমা হয়েছে। সঞ্চালন মাশুল বাড়লে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।

তবু তিতাসের প্রকল্প :গ্যাস সংকটের কারণে কয়েক বছর ধরে আবাসিকে সংযোগ বন্ধ রয়েছে। নতুন সিএনজি স্টেশন স্থাপনের অনুমতি মিলছে না। শিল্পেও বাছবিচার করে দেওয়া হচ্ছে সংযোগ। এরপরও নতুন পাইপলাইন স্থাপন ও বিদ্যমান অবকাঠামো উন্নয়নে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা খরচের উদ্যোগ নিয়েছে তিতাস। এসব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ চার লেন মহাসড়কে বিদ্যমান গ্যাস নেটওয়ার্ক প্রতিস্থাপন (১৯৪ কিলোমিটার), ১ হাজার ৩২৭ কোটি টাকার এলেঙ্গা থেকে মানিকগঞ্জ পর্যন্ত ৫০২ কিলোমিটার ও মানিকগঞ্জ থেকে ধামরাই পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার লাইন নির্মাণ প্রকল্প এবং ১ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকার ঢাকা-টাঙ্গাইল চার লেন মহাসড়কে বিদ্যমান নেটওয়ার্ক প্রতিস্থাপন (২২১ কিলোমিটার) প্রকল্প।

দায় ভোক্তার ওপর :কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম সমকালকে বলেন, যাচাই-বাছাই ছাড়া কোম্পানিগুলো প্রকল্প নেয়। ঋণ করে নেওয়া এসব প্রকল্পের বিনিয়োগ উসুল হয় না। ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে লোকসান গুনে কোম্পানিগুলো। যার দায় চাপানো হয় গ্রাহকের ওপর। ক্ষতি সামলাতে বারবার বাড়ানো হয় দাম। গ্যাস না পেলেও এখন বাসাবাড়ির গ্রাহকদের দুই চুলায় মাসে ১ হাজার ৮০ টাকা বিল দিতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ সমকালকে বলেন, আমাদের নেটওয়ার্ক অনেক পুরোনো ও জীর্ণ, তাতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে। এ জন্যই পাইপলাইন প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নেটওয়ার্ক আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। গ্যাস সংকটের সময় এমন বিনিয়োগ কোম্পানির জন্য বোঝা হবে কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বোঝা নয়, বরং এই বিনিয়োগ তিতাসকে একটি আধুনিক ও স্মার্ট সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলবে।

জিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী রুখসানা নাজমা ইসহাক সমকালকে বলেন, ভবিষ্যতে বিনিয়োগ কী ফল বয়ে আনবে, তা এখন বলা সম্ভব না। তবে বর্তমানে কোম্পানি লোকসানে রয়েছে। তাই মার্জিন বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। না হলে চলমান উন্নয়ন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে।

এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, জ্বালানি সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকারের সঙ্গে একাধিক উপায়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সার্বিক বিষয়ে মন্তব্য জানা যায়নি।-সমকাল