ধোঁয়া দিতে আমদানি ৬ কোটির ম্যালাথিয়ন, কিন্তু মেয়র শিখে এসেছেন এতে মশা মরে না

ধোঁয়া দিতে আমদানি ৬ কোটির ম্যালাথিয়ন, কিন্তু মেয়র শিখে এসেছেন এতে মশা মরে না

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র, কর্মকর্তা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলররা শিখে এসেছেন ধোঁয়া দিয়ে মশা মারার পদ্ধতি (ফগিংয়ের মাধ্যমে পরিপক্ব মশা নিধন) ভুল। এ পদ্ধতিতে মশা তো মরেই না, শুধু অর্থেরই অপচয় হয়।
এ বিষয় জানার পরও এই পদ্ধতিতে মশা মারার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি। কারণ, ধোঁয়া দিয়ে মশা মারতে আগে যে কীটনাশকটি কেনা হয়েছিল, তা এখনো শেষ হয়নি। এখানেই শেষ নয়, এ পদ্ধতিতে মশা মারতে আরও প্রায় ছয় কোটি টাকার কীটনাশক আমদানি করা হচ্ছে।

ধোঁয়া দিয়ে মশা মারতে ম্যালাথিয়ন নামের একটি কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। ঢাকা উত্তর সিটির ভান্ডার ও ক্রয় শাখার কর্মকর্তারা জানান, চীন থেকে আরও ম্যালাথিয়ন আমদানি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কীটনাশকটি শিপমেন্ট করেছে।

দেশে মশা মারার প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অন্যতম ধোঁয়া দেওয়া, যা ফগিং নামে পরিচিত। এ পদ্ধতিতে পরিপক্ব বা উড়ন্ত মশা মারতে ধোঁয়ার মাধ্যমে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। ঢাকা উত্তর সিটিও এ পদ্ধতি ব্যবহার করে। তারা ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি মাত্রায় আমদানির পর ৫ শতাংশ হারে ডিজেলের সঙ্গে মেশায়। পরে ফগার যন্ত্রের সাহায্যে ধোঁয়া হিসেবে প্রয়োগ করে।

গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি শহর পরিদর্শনের পর ঢাকায় মশা নিধন পদ্ধতিতে ভুল রয়েছে জানিয়েছিলেন উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এত দিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। তাতে মশা তো ধ্বংস হয়নি, বরং অর্থের অপচয় হয়েছে।’

মেয়র এ-ও বলেছিলেন, ফগিংয়ে অর্থ অপচয় না করে লার্ভিসাইডিংয়ে (মশার লার্ভা নিধনে ওষুধ ছিটানো) মনোযোগী হতে হবে। ঢাকা উত্তর সিটির প্রতিনিধিদের মিয়ামি শহর কর্তৃপক্ষ বলেছে, ফগিং পুরোনো পদ্ধতি। এটা দিয়ে কখনো মশা মরে না।

বিটিআই নামের কীটনাশকও আনা হচ্ছে

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফগিংয়ের জন্য ৯৬ হাজার লিটার ম্যালাথিয়ন আমদানি করছে ঢাকা উত্তর সিটি। ক্রয়াদেশ অনুযায়ী, লিটারপ্রতি এই কীটনাশকের দাম পড়েছে ৫ দশমিক ৮৫ ডলার। এ হিসাবে ৯৬ হাজার লিটারের দাম ৫ লাখ ৬১ হাজার ৬০০ ডলার।

ভান্ডার শাখার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ম্যালাথিয়ন আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল গত নভেম্বর মাসে। ওই সময় আমদানির ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল গড়ে ১০৫ টাকা। এ হিসাবে আমদানি প্রক্রিয়ায় থাকা ওই কীটনাশকের দাম ৫ কোটি ৮৯ লাখ ৬৮ হাজার টাকা।

ভান্ডার শাখা বলছে, সর্বশেষ গত বছরের মার্চে ৪৮ হাজার লিটার ম্যালাথিয়ন আমদানি করা হয়েছিল। তখন প্রতি লিটারের দাম পড়েছিল ৫ দশমিক ৭৫ মার্কিন ডলার। গত মাস পর্যন্ত ওই কীটনাশকের ১২ হাজার ৩০০ লিটার মজুত ছিল।
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান ভান্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, নভেম্বরের দিকে ম্যালাথিয়ন ওষুধ আমদানির সিদ্ধান্ত (ফাইল অনুমোদন) হয়েছিল; অর্থাৎ সেটা ছিল মেয়র, কর্মকর্তা ও কাউন্সিলরদের যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার আগে।  

নতুন করে কীটনাশক আমদানির বিষয়ে মেয়রের উপদেষ্টা কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওষুধ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ভাণ্ডার ও ক্রয় শাখা। সুতরাং ওষুধ আমদানির বিষয়ে তারাই ভালো বলতে পারবেন।’ তবে মশা নিধনে ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস ইসরাইলেন্সিস (বিটিআই) নামের একটি কীটনাশক আমদানির প্রক্রিয়া চলছে বলে তিনি জানান।

এখনো চূড়ান্ত হয়নি এসওপি

যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও মশকনিধনের পরামর্শকদের নিয়ে একটি সভা করেছিলেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। সভায় স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর (এসওপি) প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র সফরের অভিজ্ঞতায় মশা নিধনে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে আরও একটি সভা হয় গত ৯ ফেব্রুয়ারি।

এরপর গত ১৩ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন মেয়র। তাতে যুক্তরাষ্ট্রে অভিজ্ঞতার আলোকে মশা নিধন কার্যক্রম শুরু করেছেন বলে জানিয়েছিলেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসওপি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ কাজে গবেষণাগার বা পরীক্ষাগারের বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

ঢাকা উত্তর সিটির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে শেখা মূল বিষয়টি ছিল পরীক্ষাগারে মশার প্রজাতি নির্ণয় করা। এরপর ওষুধ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া। কিন্তু এর কিছুই এখনো এগোয়নি।  

কর্মকর্তারা বলছেন, সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষাগার স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে। তাই দেশের কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য যেসব শর্ত পূরণ করা প্রয়োজন, সেগুলো কিছুই করা হয়নি।

এসওপির বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়রের উপদেষ্টা কবিরুল বাশার বলেন, ‘এসওপির একটি অংশ, জনবলের (অর্গানোগ্রাম) যে খাতটি; অর্থাৎ কোথায় কত কর্মী লাগবে, তা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি মশকনিধন কর্মীদের কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছে। গবেষণাগারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।’