রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক দশক আজ

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির এক দশক আজ

আজ ২৪শে এপ্রিল। ২০১৩ সালের এই দিনে ঢাকার অদুরে সাভারের রানা প্লাজা ধসে পড়ে এক হাজার ১৩৬ জন নিহত হন। এ ঘটনায় দায়ের করা দুই মামলার বিচার এক দশকে শেষ হয়নি। উচ্চ আদালতের আদেশে প্রায় ছয় বছর স্থগিত ছিল হত্যা মামলাটি। তবে গত বছর মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে। এরপর বিচারে কিছুটা গতিও পেয়েছে। তবে ইমারত বিধিমালা না মেনে ভবন তৈরির মামলাটি উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে। 

রানা প্লাজা ধসের পরপরই বেশ কয়েকটি মামলা হলেও মূল মামলা দুটি। এর একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে, অপরটি ইমারত বিধিমালা না মেনে ভবন তৈরির। দুই মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা কারাগারে থাকলে অধিকাংশ আসামি জামিনে এবং পলাতক রয়েছেন। যদিও মামলার মূল আসামি ভবন মালিক সোহেল রানা সম্প্রতি হাইকোর্ট থেকে জামিন পান।

তবে আপিল বিভাগে সেই জামিন স্থগিত থাকায় এখনো তিনি মুক্তি পাননি।

মামলা দায়েরের দুই বছরের বেশি সময় পর ২০১৫ সালের ১ জুন তদন্ত শেষে পৃথক দুটি চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর। যার একটিতে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে ভবন মালিক সোহেল রানা ও তার বাবা-মা এবং তৎকালীন সাভার পৌরসভার মেয়র ও কমিশনারসহ ৪১ জনকে এবং অপরটিতে ইমারত বিধি না মেনে রানা প্লাজা নির্মাণের অভিযোগে সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। দুটি চার্জশিটে মোট আসামি ৪২ জন। এর মধ্যে সোহেল রানাসহ ১৭ জন দুটি মামলারই আসামি। এ দুটি মামলায়ই পৃথক দুই আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন।

হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণে গতি: ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকার তৎকালীন জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান ৪১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। রানা প্লাজা ধস হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবনের মালিক সোহেল রানা। আসামিদের মধ্যে সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক, আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যান।

অভিযোগ গঠনের পরপর সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানসহ আটজন উচ্চ আদালতে মামলা বাতিল চেয়ে আবেদন করেন। তাদের পক্ষে মামলার কার্যক্রম স্থগিতসহ রুল ইস্যু করা হয়।

উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে আটকে যায় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া। সম্প্রতি মোহাম্মদ আলী খান বাদে অন্য আসামিদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়। অভিযোগ গঠনের সাড়ে পাঁচ বছর পর ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি এই মামলায় ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। গত এক বছরে মামলাটিতে ৪৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিমল সমাদ্দার।

কবে নাগাদ মামলাটির বিচার শেষ হবে বলে আশা করছেন, এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বিমল সমাদ্দার বলেন, প্রায় ছয় বছর উচ্চ আদালতের আদেশে এই মামলার বিচারকাজ স্থগিত ছিল। গত বছর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার পর এক বছরে প্রায় অর্ধশত সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে। প্রতি মাসেই তারিখ হচ্ছে। আমরা ১০/১৫ জন সাক্ষীর প্রতি কোর্ট থেকে সমন ইস্যু করছি। অনেক সাক্ষীকে পাওয়া যাচ্ছে না। মামলার সময় তাদের বর্তমান ঠিকানা দেওয়া হলেও তারা এখন সেই ঠিকানায় থাকছেন না। অনেকে অসুস্থ ও পঙ্গু হয়ে গেছেন বলে আদালতে আসতে পারছেন না। তবুও প্রতি তারিখে অন্তত: ৫/৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিচ্ছেন। সাক্ষী আসলে কাউকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে না।

তিনি বলেন, এই মামলায় সাক্ষী সংখ্যা ৫৯৪ জন। স্বাভাবিকভাবে বিচার শেষ করতে কিছুটা সময় লাগবে। তবে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলাটি শেষ করার ব্যাপারে আমাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নাই। আমরা দ্রুত শেষ করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি।

৭ বছর ধরে স্থগিত ইমারত আইনের মামলা: রানা প্লাজা ধসের পর ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ওইদিন সাভার থানায় একটি মামলা করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

অভিযোগ গঠনের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন। যার মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুস সামাদ ও সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে। অপরদিকে ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের রিভিশন মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর আসামি রেফায়েত উল্লাহার পক্ষে উচ্চ আদালত মামলাটির উপর এক বছরের স্থগিতাদেশ দেন। তাই দীর্ঘদিনেও মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি বলে জানান ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবির বাবুল। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় চার্জগঠনের সাত বছরেও মামলাটিতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি। এই মামলায় উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ বিষয়ে পরবর্তী আদেশ দাখিলের জন্য সোমবার (২৪ এপ্রিল) দিন ধার্য রয়েছে।

দুদকের দুই মামলায় রায়: রানা প্লাজা ধসের পর সোহেল রানাকে গ্রেপ্তারের পর তার ও পরিবারের সদস্যদের নামে তিনটি মামলা করে দুদক। যার মধ্যে সম্পদের হিসাব দাখিল না করা সংক্রান্ত নন-সাবমিশন মামলায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট রানার তিন বছর কারাদণ্ড হয়। এ মামলায় তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এদিকে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমের ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার ৬ কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন আদালত। এছাড়া ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের আরেকটি মামলা রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর ১ হাজার ১১৭ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৯ জন মারা যায়। ধ্বংসস্তূপ থেকে ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। মৃত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ৮৪৪ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা রেখে ২৯১ জনের অসনাক্তকৃত লাশ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। জীবিত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ১ হাজার পাঁচশ ২৪ জন আহত হন। তদের মধ্যে গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন ৭৮ জন।