‘হেলমেট বাহিনীর’ গ্রেপ্তার কতোদূর?

‘হেলমেট বাহিনীর’ গ্রেপ্তার কতোদূর?

ঢাকা, ১১ আগস্ট (জাস্ট নিউজ) : ঢাকায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় ছাত্র ও সাংবাদিকদের ওপর হামলায় আলোচনায় এসেছে ‘হেলমেট বাহিনী'৷ আন্দোলনে ‘উসকানির' অভিযোগে ২২ ছাত্র গ্রেপ্তার হলেও দুর্বৃত্তদের ব্যাপারে রহস্যজনকভাবে নীরব সরকার৷

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয় ২৯ জুলাই থেকে৷ ওই দিন দুপুরে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের অদূরে বিমানবন্দর সড়কে (র‌্যাডিসন হোটেলের উল্টো দিকে) বাসচাপায় রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া খানম মীম ও আব্দুল করিম নিহত হন৷

টানা আট দিনের আন্দোলন শেষ হয় ৫ আগস্ট৷ তবে এরপরও আরো দু'দিন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আন্দোলন চালায়৷ পুলিশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েরে ২২ জন ছাত্রকে আটক করেছে৷ দুই দিনের রিমান্ড শেষে তাদের কারাগারেও পাঠানো হয়েছে৷

শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, ‘দোষী' শিক্ষার্থীদের কোনো ছাড় দেবে না সরকার৷

এদিকে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ‘ষড়যন্ত্র করে ভিন্নখাতে নেয়ার চেষ্টার' অভিযোগে খ্যাতিমান ফটোসাংবাদিক ড. শহীদুল আলমসহ আরো কয়েকজনকে আটক করেছে৷ মামলা হয়েছে কয়েকজন বিএনপি নেতার বিরুদ্ধেও৷ ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে হামলার অভিযোগেও ধানমন্ডি থানায় আরেকটি মামলা করেছে আওয়ামী লীগ৷

আন্দোলনের শেষের দুই-তিনদিন হেলমেট পড়ে সশস্ত্র অবস্থায় কিছু যুবক ধানমন্ডি, জিগাতলা এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় শিক্ষার্থী এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলা করে৷ কিন্তু পুলিশের পাশে দাঁড়িয়েই হামলায় অংশ নিলেও তারা কারা, এখন আর সে ব্যাপারে কিছু বলছে না পুলিশ৷

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে যারা নাশকতা করেছে, যারা গুজব ছড়িয়ে দেশকে অশান্ত করা চেষ্টা করেছে তাদের চিহ্নিতকরণের কাজ চলছে৷ ইতিমধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অনেককে আটক করা হয়েছে৷ তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না৷’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘আপনারা অনেক তথাকথিত দায়িত্বশীল নেতার অডিও-ভিডিও রেকর্ড শুনেছেন৷ এমন আরও কয়েকজন তথাকথিত দায়িত্বশীল নেতার অডিও রেকর্ড পুলিশের হাতে রয়েছে৷ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে নিজেদের লোকজন অনুপ্রবেশ করিয়ে ধংসাত্মক পরিবেশ তৈরি করার অপচেষ্টা সেসব তথাকথিত দায়িত্বশীল নেতার অডিওতে উঠে এসেছে৷ যারা এসব ধরনের ইস্যুকে ভিন্ন খাতে প্রভাহিত করে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না৷’’

কিন্তু সাংবাকিদের প্রশ্ন ছিল সাংবাদিক ও ছাত্রদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করা হবে কিনা? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘‘কেউ অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নেব৷ আমরা নিজেরাও হামলাকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি৷’’

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সপ্তম দিন ৪ অগাস্ট জিগাতলা ধানমন্ডি এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ছাত্রদের ওপর হামলা হয়৷ যারা হামলা করেন তারা পুলিশের সঙ্গেই ছিলেন৷ তাদের মাথায় ছিল হেলমেট এবং হাতে লাঠি, রড, জিআই পাইপ এবং রামদা ও চাপাতি দেখা গেছে৷ এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালাতেও দেখা গেছে একাধিক যুবককে৷

পরের দিন ৫ আগষ্ট আবারো সেসব এলাকায় ছাত্রদের ওপর হামলা হয়৷ সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় হামলা হয় সাংবাদিকদের ওপর৷ পুলিশের সামনেই হেলমেটধারীরা হামলা চালায়৷ তারা রীতিমিত সশস্ত্র অবস্থায় পুরো এলাকা জুড়ে মহড়া দেয়৷ হামলার শিকার বণিক বার্তার ফটো সাংবাদিক পলাশ শিকদার ওই দিন ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছিলেন, ‘‘হেলমেটধারীরা সায়েন্স ল্যাবরেটরি পুলিশ বক্সের পাশে রাস্তায় আমাদের মারধর করে৷ আমার ক্যামেরা ছিনিয়ে নেয় এবং ভেঙ্গে ফেলে৷ তারা রড এবং পাইপ দিয়ে আমাদের পেটায়৷ এমনি রামদার পিছন দিক দিয়ে আঘাত করে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আমাদের ওপর হামলার সময় পুলিশ ছিল৷ কিন্তু তারা আমাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি৷ এমনি আমরা পাশের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলেও আমাদের চিকিৎসা দেয়া হয়নি৷’’ হামলাকারী সাতজনের ছবি তুলে রেখেছেন বলেও জানান পলাশ শিকদার৷

কিন্তু হেলমেটধারীরা কারা? পলাশের বক্তব্য, এরা কোনোভাবেই শিক্ষার্থী হতে পারেন না৷ তিনি বলেন, ‘‘ধারণা করছি তারা ছাত্রলীগ-যুবলীগের৷ তারা প্রকাশ্যে রাস্তায় সশস্ত্র মহড়া দিচ্ছিল৷’’

হামলার পুরোটা সময় হামলাকারীরা পুলিশের সঙ্গে থাকলেও পুলিশ তাদের তখন গ্রেপ্তার বা আটক করেনি৷ এরপর তথ্যমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার কথা বললেও গত এক সপ্তাহেও এর কোনো অগ্রগতি নেই৷

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোল্লা জালাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যারা হামলা করেছে, তাদের ছবি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে৷ তাদের ভিডিও ফুটেজ আছে৷ তারা চিহ্নিত৷ তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে৷ আমরা হামলাকারীদের গ্রেপ্তার দেখতে চাই৷ এরমধ্যে যদি গ্রেপ্তার না হয় ১৬ আগস্ট আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও করব৷’’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারে সাবেক উপদেষ্টা এবং মানবাবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আইনের চোখে সবাই সমান এবং সবার ক্ষেত্রে আইন সমানভাবে প্রযোজ্য হবে৷ আমরা মানবাধিকারের জন্য কাজ করি বলে এটাও বলিনা যে যারা অপরাধ করবে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে না৷ যারা অপরাধ করবে, তাদের নিশ্চয়ই আইনের আওতায় আনা হবে৷ কিন্তু সেখানে যখন পক্ষপাতিত্ব হয়, সেখানে দেখা যায় যারা স্পষ্টতই অনেকগুলো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করলো, তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না৷ কিন্তু শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে, আন্দাজের ভিত্তিতে অন্যদের ধরে নিয়ে গিয়ে আইনের প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকানো হলো, সেখানে আমাদের প্রচণ্ড আপত্তি আছে৷ এটা নিয়ে আমরা প্রতিবাদও জানিয়েছি৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কথা হল, এই যে চিহ্নিত সন্ত্রাসী৷ যার সশস্ত্র হয়ে আক্রমণ করলো নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপরে৷ সেখানে যদি পুলিশ কোনো ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে আইনের প্রতি, বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষ আরো বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়বে৷ যা করা হচ্ছে তা উচিত নয়৷ এটা অত্যন্ত অন্যায় বলে আমরা মনে করি৷’’

ছাত্র ও সাংবাদিককদের ওপর হেলমেটধারী হামলাকারীরা এখনো কেন গ্রেপ্তার হয়নি জানতে চাইলে ডিএমপি উপ কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেক বলেন, ‘‘এই সময়ে যা ঘটেছে তার সবকিছু নিয়েই কাজ করছে পুলিশ৷ যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছে সেখানে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি এবং নিচ্ছি৷ ছাত্র ও সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হলে আমাদের পক্ষে ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হত৷ কিন্তু তারপরও আমরা কাজ করছি৷ বেশ কিছু দুর্বৃত্তকে চিহ্নিত করেছি৷ তাদের গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ আমাদের পুলিশ সদস্যরাও হামলার শিকার হয়েছে৷ তারাও আহত হয়েছে৷ তাদের ওপর হামলাকারীদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে৷’’

ভিডিও ফুটেজ, ছবি এবং গোয়েন্দা ও নিজস্ব সূত্র থেকে তথ্য নিয়ে তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে বলেও জানান মাসুদুর রহমান৷ সূত্র: ডয়চে ভেলে।

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২৩৪৬ঘ.)