“ড্রিবল মিশিগান” এর জমকালো বনভোজন এবং মিশিগান প্রবাসী বাংলাদেশী ফুটবলারদের ইতিকথা

“ড্রিবল মিশিগান” এর জমকালো বনভোজন এবং মিশিগান প্রবাসী বাংলাদেশী ফুটবলারদের ইতিকথা

প্রতি বছরের মতো এবারও যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের বৃহত্তর ট্রয় অঞ্চলে বসবাসরত বাংলাদেশী ফুটবল প্রেমীদের সমন্বয়ে গঠিত "ড্রিবল মিশিগান" এর বাৎসরিক পিকনিক অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো

গত শনিবার, ২৪ আগস্ট, শেলবি টাউনশিপের স্টোনিক্রিক মেট্রো পার্কে। খেলোয়াড়দের পাশাপাশি তাদের পরিবার পরিজনের উপস্থিতির কারণে পিকনিকটি হয়ে ওঠে ফুটবল প্রেমীদের বাংলাদেশী মিলন মেলা। বনভোজনে ঝালমুড়ি, সিঙ্গারা, বারবিকিউ, বার্গার, দেশি স্বাদের বিরিয়ানী, হাতে বানানো বুন্দিয়া সহ বিভিন্ন রকম মিষ্টান্ন এবং মৌসুমী ফলের সমারোহ সহ নানা পদের খাবারের পাশাপাশি, ভলিবল, ক্রিকেট সহ হরেক রকম খেলারধুলার ব্যবস্থা ছিলো বনভোজনের বাড়তি আকর্ষণ।

ড্রিবল মিশিগানের যাত্রা শুরু যেভাবেঃ
বর্তমান বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত খেলা ক্রিকেট হলেও সেই আদিকাল থেকে বেশিরভাগ বাংলাদেশীর প্রিয় খেলা ফুটবল। একটা সময় ছিলো যখন দেশের মানুষের বিনোদনের মাধ্যম ছিল খুব সীমিত। সেই সময় ফুটবলের মতো জনপ্রিয় খেলা তাদের বিনোদনের খোরাক জগত বহুলাংশে। দেশের জাতীয় দল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তেমন সফলতা দেখতে না পারলেও জাতীয় পর্যায়ের ফুটবল ক্লাব যেমনঃ মোহামেডান, আবাহনী, ব্রাদার্স ইউনিয়ন সহ আরো কিছু ক্লাবের ভক্তকুল ছিল দেশজুড়ে। গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলাগুলিতে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ক্লাব মোহামেডান এবং আবাহনী যখন মুখোমুখি হতো, তখন প্রায় সাড়া দেশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেতো। ঢাকা স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যেতো দর্শকে। দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, বিচ্ছিন্ন মারামারির মতো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটতে দেখা যেতো প্রায়শ্যই। এসব এখন শুধুই ইতিহাস। কালের আবর্তে ক্রিকেট দেশের সব চেয়ে আলোচিত খেলা হয়ে ওঠায়, ফুটবল তার জৌলুশ হারায় দেশের ক্রীড়াঙ্গন থেকে। সেই জমজমাট ফুটবলের স্বর্ণালী যুগে কিছু বাংলাদেশী ফুটবল প্রেমীর আগমন ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যে। তারা দেশের ফুটবলের সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেই স্বল্প পরিসরে কিছু বাংলাদেশী মিশিগান প্রবাসীরা স্থানীয় জেইসি পার্ক, সহ বিভিন্ন মাঠে খেলা শুরু করে। তবে যথেষ্ট খেলোয়াড় না থাকায় বিভিন্ন দেশী খেলোয়াড়দের সমন্বয়ে তারা নিয়মিত খেলতে শুরু করে। সময়ের আবর্তে বাংলাদেশী খেলোয়াড়দের সংখ্যা বাড়তে থাকলে তারা শুধু বাংলাদেশী খেলোয়াড়দের নিয়েই খেলা শুরু করে। তখন থেকে এটা মূলত বাংলাদেশীদের ফুটবল দল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তবে সেই সময় যোগাযোগের কোনো সুনির্দিষ্ট মাধ্যম ছিলোনা বিধায় কোনো সমন্বিত টিমওয়ার্কও ছিলোনা। এই সমস্যা উপলব্ধি করে ২০০৭-২০০৮ সালের দিকে কন্টিনেন্টালে কর্মরত সফটওয়্যার প্রকৌশলী কর্মকর্তা জিন্নু রাইন (রাজীব) এর উদ্যোগে "ড্রিবল মিশিগান" নামে একটি ইমেইল ভিত্তিক গ্রুপ তৈরী করে প্রতি সপ্তাহের খেলার মাঠ এবং সময়সূচি নির্ধারণের যোগাযোগ সমন্বয় শুরু হয়। তখন থেকে শুরু হওয়া সেই গ্রুপের অধীনেই আজও প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত বাংলাদেশী ফুটবল খেলোয়াড়দের জমজমাট আসর বসে মিশিগানের ট্রয় অঞ্চলের বিভিন্ন ফুটবল মাঠে। তবে ড্রিবলের ইতিহাসের দিকে দেখা যায়, কখনো এই দলটিকে ষ্টার (এস টি এ আর) বা স্ট্র (এস টি আর এ ডব্লিউ) নামেও ডাকা হয়। ষ্টার (এস টি এ আর) দিয়ে স্টার্লিং হাইটস, ট্রয়, অবার্নহিলস, রচেস্টার, রচেস্টার হিলস নামের পাঁচটি শহরের অধিবাসী ফুটবলারদের সমন্বয় করা হয়। পরবর্তীতে ওয়ারেন শহর যুক্ত হলে নাম হয়ে যায় স্ট্র।

প্রায় ১৮ বছর আগে শুরু হওয়া সেই বাংলাদেশী ফুটবল আসরের অনেক সদস্য বিভিন্ন কারণে অন্যান্য স্টেটে চলে গেলেও অনেক সদস্য এখনো মিশিগানে রয়ে গেছেন, যাদের অনেকে এখনো নিয়মিত খেলায় অংশগ্রহণ করে থাকেন। প্রথম পর্যায়ের যারা খেলা শুরু করেছিল তাদের মধ্যে অন্যতম কমিউনিটির সবার পরিচিত মুখ ফেরদৌস গাজী, আবিয়া নেতা মনির জামান, ফোর্ড মোটোর কোম্পানির প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট এবং বুয়েট টিমের সাবেক ফুটবলার গোলাম মুস্তাফা, মিশিগানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার বর্তমানে ফোর্ড মোটরস কোম্পানিতে কর্মরত প্রকৌশলী আলমগীর হোসাইন, জেনারেল মোটোর্স্ এর দুই প্রকৌশলী ফুটবলার জিয়া হক এবং সোহেল আহমেদ, ময়মনসিং জেলা ক্রীড়ার সংস্থার সাবেক ফুটবলার, প্রকৌশলী তারিক মাহমুদ (সজু), ট্রয় এর সুপরিচিত ব্যবসায়ী আরিফ শাকুয়া, টিআরডাব্লিউ'র প্রকৌশলী এবং সাবেক ফুটবলার মোঃ আরিফ ইসলাম (নাজমুল) প্রমুখ।

ড্রিবল মিশিগানের ইতিহাস সম্পর্কে জেনারেল মটরসের টেকনিক্যাল লিড ইঞ্জিনিয়ার এবং ড্রিবল মিশিগানের সিনিয়র সমন্নয়কারী মোঃ শহিদুল আলম খান (রুবেল) বলেন, "মিশিগানের ট্রয় এবং এর আশপাশের শহরে বাংলাদেশী খেলোয়াড়দের আগমন সেই ২০০০ সাল থেকেই। সেই সময় এদিকে টিম করে খেলার মতো যথেষ্ট খেলোয়াড় না থাকায় পূর্বে ক্যান্টন শহরের ওদিকে গিয়ে খেলতে হতো। সময়ের আবর্তে অনেক প্রফেশনাল কাম ফুটবলার ট্রয় সিটির আশপাশের শহরে বসবাস শুরু করলে আমরা নিজেরাই স্থানীয় জেইসি পার্কে খেলা শুরু করি। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে ড্রিবল মিশিগান আজ বাংলাদেশী ফুটবল প্রেমীদের একটি সুপরিচিত গ্রুপে পরিণত হয়েছে যা এখন শুধু একটি ফুটবল গ্রুপই নয়, এটা এখন মিশিগানে নতুন আসা আমেরিকার বিভিন্ন বিশবিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অন্যান্য বিষয়ে পাশ করা চাকুরী প্রার্থীদের নেটওয়ার্কিং গ্রুপ হিসেবেও কাজ করছে এবং অসংখ সদ্য পাশ করা বাংলাদেশী ছাত্রদের কর্ম সংস্থানে ভূমিকা রেখে চলেছে।"

নিজেদের প্রোফেশনের পাশাপাশি নিয়মিত ফুটবল খেলার এই অনুশীলন ধরে রাখা সম্পর্কে ফিয়াট-ক্রাইসলারের প্রোডাক্ট ইঞ্জিনিয়ার এবং ড্রিবল মিশিগানের সিনিয়র সদস্য ইমরান হোসাইন বলেন, "অনেক ছোটবেলা থেকেই ফুটবল আমাদের প্রিয় খেলা, সে হিসেবে খেলাধুলার চর্চাটা ধরে রাখার চেষ্টা করি। নিয়মিত জিমে গিয়ে ট্রেড মিলে দৌড়ানোর মতো বোয়িং জবের চেয়ে সুযোগ যেহেতো আছে, মাঠে গিয়ে সবাই ফুটবল খেলার, সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনা। আর তাছাড়া মিশিগানের গ্রীষ্মকালের ব্যাপ্তি খুব স্বল্প। বছরের লম্বা সময় শীতকাল, সেই সময় ঘরের বাহিরে কোনো একটিভিটি থাকেনা, তাই আমরা চেষ্টা করি সামারটা একটু ভালোভাবে কাজে লাগাতে"।

বর্তমানে সপ্তাহে নিয়মিত দুই দিন, মঙ্গলবার এবং বৃহস্পতিবার বিকেলে ট্রয় সিটির ব্রিন্সটোন পার্কে ড্রিবল গ্রুপের ফুটবল খেলা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে প্রায় ২০/২৫ জন করে বাংলাদেশি প্রবাসী ফুটবলার নিয়মিত অংশগ্রহণ করে থাকে। কখনো ফ্রেন্ডলি ম্যাচ, কখনো আন্ডার ৩৫ বনাম ওভার ২৫ এ ভাগ হয়ে, কখনো পূর্বাঞ্চল বনাম পশ্চিমাঞ্চল, কখনো ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা, আবার কখনো মোহামেডান বনাম আবাহনী সমর্থক দলে ভাগ হয়ে খেলা অনুষ্ঠিত হয়। খেলা শেষে প্রায়ই বিরিয়ানী, সিঙ্গারা, সামুচা সহ দেশি মজাদার খাবারের ব্যবস্থা থাকে যেখানে খেলোয়াড়দের পরিবার পরিজনও অংশগ্রহণ করে থাকে।

ড্রিবলের কোনো ফরমাল কমিটি না থাকলেও প্রশাসনিক এবং সাংগঠনিক দায়িত্ব এক এক সময় এক এক জন স্বেচ্ছাশ্রমে পালন করে থাকেন। বর্তমানে প্রশাসনিক এবং সাংগঠনিক দায়িত্বে আছেন দুই তরুণ প্রকৌশলী কাম ফুটবলার অভি বিশ্বাস এবং প্রণব চৌধুরী (শাওন)। এই দুই তরুণ সংগঠক বিগত দুই সেশনে সাফল্যের সাথে ড্রিবল এর প্রতি সপ্তাহের নিয়োজিত ম্যাচ আয়োজনের পাশাপাশি, বাৎসরিক পিকনিক সহ বেশ কিছু সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ইভেন্টের আয়োজন করে আসছে। শুধু তাই নয়, ড্রিবল আগে ছিলো শুধু সামার ফুটবল গ্রুপ, কিন্তু এই প্রথম তারা সারা উইন্টার জুড়ে ইনডোর ফুটবল ম্যাচের এর আয়োজন করে। এই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় আগামী উইন্টারেও ইনডোর ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।

এমজে/