কৃষকের মন পুড়েছে... নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না

কৃষকের মন পুড়েছে... নগর পুড়লে দেবালয় এড়ায় না

মোহাম্মদ আল-মাসুম মোল্লা

টিভিতে একটা বিজ্ঞাপনের কথা বেশ কিছুদিন যাবৎ মনের ভিতরে দোলা খাচ্ছে। “বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, ভাবতে ভালোই লাগে।” বিজ্ঞাপনের এই ট্যাগলাইনটির কথা অনেকের হয়তো মনে আছে। বিজ্ঞাপন যেনো বাস্তবতায় রূপ নিলো।

‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, ‘দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ’- এসব অপবাদের তকমা থেকে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার উদীয়মান বাঘ। হালুম...

অর্থমন্ত্রীর ভাষায় বাংলাদেশ এখন কানাডা ও থাইল্যান্ডের সমান। সারাবিশ্বের কাছে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। এসব আজ সরকারে কর্তাব্যক্তিদের মুখে মুখে, মন্ত্রী-এমপিদের আলোচনার বিষয়। কিন্তু সামগ্রিক চিত্র কী?

একটু আর্থিক সচ্ছলতার জন্য, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় চড়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে তরুণদের অকাল মৃত্যু।

টাঙ্গাইলে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়। আর সেখানে একজন শ্রমিকের দিনমজুরি ৮৫০ টাকা। এতে প্রতি মণ ধানে কৃষককে গুনতে হচ্ছে লোকসান। ফলে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তাই ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে টাঙ্গাইলের এক কৃষক নিজের পাকা ধানে নিজেই আগুন দিয়েছেন।

বেকার থাকার কারণে, সন্তানের দুধ কেনার জন্য সুপার শপ থেকে পিতার দুধ চুরি।

দেশের প্রায় ৮০ হাজার পাটকল শ্রমিক এই প্রচণ্ড গরমে দিনের পর দিন রাস্তায়, ন্যায্য বেতন ভাতার দাবিতে।

কেউ বলতেই পারেন এগুলো সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আসলেই কি তাই?

দেশে লাখ লাখ বেকার তরুণ-তরুণী, বছরের পর বছর চাকরি নামের সোনার হরিণের খোঁজে। কিন্তু, হরিণের আর দেখা মেলে না। তাই এক সময় তাদের অনেকে জীবনযুদ্ধে পরাজিত নাবিকের মতো একটু আর্থিক সচ্ছলতার আশায় বিদেশে পাড়ি জমায়। কেউ কেউ অবৈধভাবে স্বপ্নের দেশ ইউরোপ যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে। ঘটে স্বপ্নের সলিল সমাধি। দেশের অর্থনীতি যদি কানাডা বা থাইল্যান্ডের মতো হতো তবে কি সোনার ছেলেরা সোনার বাংলা ছেড়ে অনিশ্চিত গন্তব্যে পা বাড়াতেন।

আমাদের দেশে ধান কাটা কৃষকের কাছে একটি বড় উৎসব। ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সোনালী ধানে ফসলের মাঠ ভরপুর হলেও ধান কেটে গোলায় তুলতে পারবেন কী না সেই শঙ্কায় কৃষক। তার উপরে ধানের নেই উপযুক্ত বাজার দর। কৃষকের মুখে হাসি নেই, চেহারায় দেখা যায় হতাশার ছাপ।

দেশের বিভিন্ন জেলায় একজন কৃষি শ্রমিকের মজুরি দৈনিক অন্তত ৭০০ টাকা। এই টাকার পর একজন কৃষি শ্রমিককে দুপুরে খাবারও দিতে হয়। সব মিলিয়ে শ্রমিকের মজুরি দাঁড়ায় একমন ধানের চেয়ে অনেক বেশি। বাজারে মনপ্রতি ধানের দাম ৫০০ টাকা। এই অবস্থায় কৃষকের ধানে আগুন দেওয়া ছাড়া আর কী করার আছে? আত্মহত্যা সে তো মহাপাপ। মৌসুম শেষে আবার এই শ্রমিকেরও কাজ থাকবে না, মজুরি কমে হয়ে যাবে অর্ধেকে।

সরকারের পক্ষ থেকে এখনো তেমন কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি কৃষকের এ দুর্দশা লাঘবে। অধিকাংশ কৃষকই ধারদেনা করে জমি চাষ করেন, বাকিতে কীটনাশক কেনেন। ফসল ঘরে উঠার পর সেই টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু এবার কী হবে?

কৃষকের তো আর আদালতে গিয়ে মামলা বা রিট করার সামর্থ্য নেই যে আদালত হস্তক্ষেপ করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডায় নেই কৃষকের ইস্যু। সভা-সেমিনারে আলোচনা হয় কৃষকরা দেশের আসল নায়ক, উন্নয়নের কারিগর। কিন্তু তাতে কি কৃষকের দু’ পয়সা লাভ হয়?

সোনালি ধানের কৃষকের যখন এই অবস্থা, সোনালি আঁশের শ্রমিকের অবস্থা আর ভালো হবে কী করে?

দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের মজুরি-বেতন বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকরা অমানবিক জীবনযাপন করছে, মনের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা, ন্যায্য দাবিতে প্রচণ্ড তাপদাহকে উপেক্ষা করে রাস্তায় বিক্ষোভ করছে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে। কিন্তু, সমস্যা লাঘবে আশার আলো দেখা যাচ্ছে না।

যে টাকার জন্য আন্দোলন করছে টাকার অংকে তা কি খুব বেশি? ব্যাংকগুলো থেকে যে হারে টাকা পাচার হয়েছে তার তুলনায় তা অতি নগণ্য। সমস্যা ঐ একটাই- কথাটা বলবে কে?

কৃষকের ক্ষেতে আগুন, পাট শ্রমিকের বিক্ষোভ বা ভূমধ্যসাগরে তরুণের মৃত্যু কিংবা সন্তানের জন্য বাবার দুধ চুরি। এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

যখন কৃষক দিনের পর দিন ফসলের দাম পাবে না, শ্রমিকেরা কাজের মজুরি পাবে না তখন তাদের সন্তানেরা মোটা অংকের ঘুষ দিয়েও যখন চাকরির নিশ্চয়তা পায় না তখন ধার-দেনা করে দেশান্তরি হওয়া ছাড়া আর উপায় কী? তার সঙ্গে যদি যোগ হয় হত্যা-গুম বা জাহালমের মতো জেলে থাকা অথবা রাস্তায় চলতে গিয়ে বিনা কারণে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, তবে দমবন্ধ হওয়া এ পরিবেশ থেকে মুক্তির উপায় কী বিদেশে পাড়ি জমানো ছাড়া? দেশে এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই যে তারা এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দেবে। সো, দ্য সুনার দ্য বেস্ট!

শ্রমজীবী মানুষের হয়ে কেউ কথা বলে না, সবাই তাদের ঘামের সুফল নিতে চায়। শ্রমজীবী মানুষেরা গরিব, নিরীহ, সহজ, দুর্নীতি বোঝে না, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বোঝে না, কিন্তু তারা মানুষের দুঃখ-কষ্ট বোঝে। তাই বছরের পর বছর শত সীমাবদ্ধতায় ঘাম ঝরিয়ে যায়। তারা কানাডা বা থাইল্যান্ড বোঝে না, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কী- তারা তা জানতে চায় না। সোনার বাংলায় সোনার মানুষেরা শান্তিতে নিশ্চিন্তে থাকতে চায়- এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।

কৃষকের ক্ষেতে আগুন দেওয়া একটি ঘটনা মাত্র, কিন্তু মনে রাখতে হবে কৃষকের মন পুড়েছে, এ আগুন বিষম আগুন- নগর পুড়লে দেবালয় কিন্তু এড়ায় না।