পাশাপাশি আতংক করোনা ও ডেঙ্গু

পাশাপাশি আতংক করোনা ও ডেঙ্গু

করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। করোনার আগ্রাসী থাবায় যখন পুরো দেশের মানুষকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, তখন ঘরেও অন্য এক আতংকের ভয়ে ভীত হয়ে পড়ছে সবাই।

এই রোদ, এই বৃষ্টির এমন আবহাওয়ায় ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রজনন বেড়ে যাওয়ার আশংকা বেড়ে গেছে। বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিদিন বাড়ছে মশার লার্ভা। দেশের হাসপাতালগুলো এখন করোনা রোগী নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে। এরই মধ্যে ভয়ানক তথ্য, মার্চ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় ২৫০ এর বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হওয়া। করোনার সঙ্গে ডেঙ্গু যোগ হওয়াতে চিকিৎসা ব্যবস্থার যে টালমাটাল অবস্থা হবে সেটা বলাই বাহুল্য।

গত বছর এডিস মশার কারণে হওয়া ডেঙ্গু জ্বরের তাণ্ডব আমরা ভুলে যাইনি। ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। ২০১৯ সালে বেসরকারি হিসাবে অনেক বেশি হলেও, শুধুমাত্র সরকারি হিসাবেই ১৭৯ জনের প্রাণহানি থেকে আমরা এ বছর হয়তো যথেষ্ট শিক্ষা নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, যখন মশার বিস্তার রোধের উপযুক্ত সময় এলো তখনি করোনার পদচারনায় সব থমকে গেল।

এ বছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে প্রায় চার গুণ। তবে এপ্রিল ও মে মাসে করোনা আতংকে হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয়েছেন কম, তাই স্বাভাবিকভাবেই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও কম। কিন্তু আসলেই কি কমেছে ডেঙ্গু রোগী? বাস্তবে রোগীরা ঘরেই থাকায় ডেঙ্গু রোগী বাড়লেও তার হিসাব তালিকায় যুক্ত হচ্ছে না।

তার থেকেও ভয়ের কথা, গত বছরে প্রথম তিন মাসে ঢাকায় এডিস মশার ঘনত্ব ছিল গড়ে পাঁচ ৷ আর একই সময়ে চলতি বছর ঘনত্ব ১০। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও এডিস মশার ঘনত্ব পর্যবেক্ষণ করে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ পূর্বাভাস দিচ্ছেন, এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ গত বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাদের মতে, আগামী জুলাই-আগস্ট মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়বে। ঢাকায় মশা নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হলেও হতাশার কথা তাদের তেমন কোনো উদ্যোগই নেই। সারা দেশের চিত্রও প্রায় একই।

তবে শুধু সরকার নয়, বসবাসের জায়গার চারপাশ পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব নিজেদের উপরও বর্তায়। যেমন: বাসার আনাচে–কানাচে থাকা পুরনো টায়ার, বালতি বা ব্যবহারের অনুপযোগী জিনিস সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা; বৃষ্টি হলে পানি জমতে পারে বা পানি বের হতে অসুবিধা হয় তেমন জায়গা চিহ্নিত করে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করা; বাসায় অব্যবহৃত কমোডের ঢাকনা বন্ধ রাখা; কোথাও তিন দিনের বেশি যেন পানি জমে থাকতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। এছাড়াও নিরাপত্তার জন্য দিন ও রাতে বাসায় মশারির ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা এবং সর্বোপরি আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। তাই ডেঙ্গু জ্বর আক্রমণাত্মক হওয়ার আগেই সবাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আমাদের জন্য এই সময়ে ডেঙ্গু অতটা ভয়ের কারণ হবে না।

প্রতিদিন বাসায় থাকার সুযোগে ও সেই সঙ্গে বৃষ্টির কারণে বন্ধ অফিস ও পরিত্যক্ত স্থানে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে জন্ম নিয়েই চলেছে এডিস মশা। কিন্তু দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা রোগীসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা পাওয়াটাই সোনার হরিণ। অভিযোগ উঠছে, অনেক চিকিৎসাকর্মীই জ্বর দেখলেই করোনার ভয়ে রোগীকে সেবা দিতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। করোনা রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে ডাক্তারদের আক্রান্ত হওয়া, কোয়ারেন্টিনে ও আইসোলেশনে চলে যাওয়াও চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডেকে আনছে চরম বিপর্যয়। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ বুঝতেই পারছেন না কোনটা করোনা, কোনটা ডেঙ্গু আর কোনটা সাধারণ ফ্লু। এমনকি চিকিৎসাকর্মীরাও এক ধরনের জটিলতায় পড়ে যাবেন ও যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে করণীয় হচ্ছে— এই তিনটি জ্বরের পার্থক্য ভালো ভাবে বোঝা যায় এমন প্রচারণা চালানো। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রয়োজনে আরও বেশি করে বুঝিয়ে দেওয়া, যাতে করে তারা দ্রুত কে কোন উপসর্গে আক্রান্ত তার প্রাথমিক ধারনা পেতে পারেন এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা দিতে পারেন। নয়তো জ্বর শুনলেই মানুষের মনে যে আতংক জেঁকে বসেছে তা কিছুতেই কাটবে না।

এ পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত যত দ্রুত সম্ভব পুরো দেশের বিভিন্ন স্থান জীবাণুমুক্ত করার পাশাপাশি মশা নিধনের কার্যক্রমও জোরদার করা। আর কালক্ষেপণ করার কোনো সুযোগ নেই। মশা মারার কার্যকর ওষুধের স্বল্পতা, ওষুধ না ছিটানো, জনবলের অভাব এসব পুরানো সমস্যা তো আছেই। শুধু দেখানো জন্য যত্রতত্র ফগিং করা নয়, বরং ফগিং করে মশা মরছে বা কমছে কিনা তা মনিটরিং করতে হবে নিয়মিতভাবে। ডেঙ্গু যেন এ বছর আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ না হতে পারে, এ জন্য মশা দমন ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। নয়তো করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুতেও মৃত্যুর মিছিল শুধু দীর্ঘই হতে থাকবে।

তানজিনা আকতারী: সংবাদ পাঠক, বাংলাদেশ বেতার ও গণমাধ্যম কর্মী