হিটলার ও পুতিনের মধ্যকার মিল, ইউক্রেন দখল: তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অসনি সংকেত

হিটলার ও পুতিনের মধ্যকার মিল, ইউক্রেন দখল: তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অসনি সংকেত

আবু সাঈ দ আনসারী

জানিনা আপনারা বিষয়টিকে কিভাবে নেবেন, তবে আমি একেবারেই বাস্তবতা থেকে লিখছি, ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বে রাশিয়ার আঘাত হানা মানে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হতে পারে। যদি আপনি ইতিহাস পর্যালোচনা করেন, দেখবেন, এডলফ হিটলার এভাবেই ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ড দখল করেছিলেন। যার থেকেই বিশ্বযুদ্ধের সূচনা। ঠিকই একই স্টাইলে ভ্লাদিমির পুতিন এগুচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।

হিটলার যখন পোল্যান্ড কিংবা হাঙ্গেরিতে গিয়ে নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করছিলেন তখন কেউ তাড়াতাড়ি বাঁধা দেয়নি যার ফলশ্রুতিতে ৭০ থেকে ৭৫ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ দিতে হয়েছিলো।“ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।” আজ তাই হতে চলেছে। History is repeating itself. তা খুবই দুঃখজনক।

পুতিন এমন এক রাষ্ট্রপতি যিনি ২০১২ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন। এই দশ বছরে রাশিয়াকে তিনি অনেক কিছু দিয়েছেন। ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৯৯ সালে পুতিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে রুশ প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বরিস ইয়েলৎসিন আকস্মিকভাবে পদত্যাগ গ্রহণ করার প্রেক্ষাপটেই তার এই দায়িত্বভার গ্রহণ। ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি জয়লাভ করেন। ২০০৪ সালে পুতিন ২য় মেয়াদে পুনরায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। তার এ মেয়াদ শেষ হয় ৭ মে, ২০০৮ সালে। কিন্তু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতাজনিত কারণে পুতিন ধারাবাহিকভাবে ৩য় মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।

পুতিনের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে রাশিয়ায় অর্থনৈতিক ভিত মজবুত হয়। ৯ বছরের মধ্যে জিডিপি ৭২% বৃদ্ধি পায়। দারিদ্র্য কমপক্ষে ৫০% কমে যায়। গড় মাসিক বেতন $৮০ থেকে $৬৪০ ডলার বৃদ্ধি পায়। ঠিক একইভাবে হিটলারও রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন, সামরিক বাহিনীকে নতুন নতুন সব অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করেছিলেন এবং সর্বোপরি একটি সমগ্রতাবাদী ও ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

পুতিন কিন্তু সিরিয়ার বাশার আল আসাদকে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন শুরু থেকে। বিশ্ব রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সিরিয়ার আজকের পরিনতির জন্য পুতিনকেও দায়ী করেন। ঠিক হিটলারও ইটালির মুসোলিনিকে সাহায্য করতেন। দুজন ডিক্টেটরের মধ্যেকার সুসম্পর্ক ছিলো।

"অন্যায় যখন নিয়ম হয়ে ওঠে, প্রতিরোধ তখন কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়!" কিন্তু এ ক্ষেত্রে বড় বড় মোড়ল রাষ্ট্রগুলো প্রতিরোধের ক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছে। ইরাক কিংবা লিবিয়া হলে তারা অনেক আগেই হামলা চালিয়ে তাদের শক্তিকে নস্যাৎ করে দিতে পারতো কিন্তু পুতিনের সাথে লড়া এতোটা সহজ না, এটা বুঝতে বাকী নেই।

ইউক্রেনে কি করতে চায় রাশিয়া? ইউক্রেন যাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর মত পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে না পারে সেই চেষ্টা বহুদিন ধরেই করছে রাশিয়া।
রাশিয়ার নিরাপত্তা দাবিগুলোর মূলে রয়েছে ইউক্রেনকে কখনওই ন্যাটো সামরিক জোটে নেওয়া চলবে না।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং রাশিয়া- উভয়ের সাথেই ইউক্রেনের সীমান্ত রয়েছে, কিন্তু সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হওয়ার কারণে রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের ঐতিহাসিক সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রয়েছে। রুশ ভাষা সেদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

২০১৪ সালে যখন ইউক্রেনে রুশ-পন্থী প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, রাশিয়া সৈন্য পাঠিয়ে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। একই সময়ে রাশিয়ার সাহায্যে জাতিগত রুশ বিদ্রোহীরা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বড় একটি এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

তখন থেকেই বিদ্রোহীদের সাথে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর থেকে থেকে লড়াই চলছে যাতে ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার কারণে ঐতিহাসিক রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডও হাতছাড়া হয়ে গেছে। রাশিয়া সে অংশগুলো ফেরত নিতে চায় আর সেজন্য যুদ্ধের ডামাডোল।

দুনিয়ার সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষদের অন্যতম দেশ ইউক্রেন। এমনকি বিলেত ও আমেরিকা থেকে মানুষ সেখানে গিয়ে লেখাপড়া করছে। আমার এক ভাগ্নে তানিম সেখানে মেডিক্যাল সাইন্স পড়ছে। ইউক্রেন আগাগোড়া এক কৃষি প্রধান দেশ। দুনিয়ার শস্যভাণ্ডারের অন্যতম যোগানদাতা হল ইউক্রেন। ইউরোপের সবচেয়ে বেশি আবাদযোগ্য জমিও কিন্তু সেখানে। কাজের সুবাধে আমি নিজে ইউক্রেনের মানুষের সাথে বহুবার বসেছি। Mondelez International কোম্পানিতে আমি Halal Food Authority থেকে অডিট করি, Oreo biscuits and cookies সেখানেই তারা produce করেন। আমরা তাদেরকে Halal certify করি। তাদের মানুষগুলো friendly.

আমি টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করলে প্রায়ই আগে ইউক্রেন থেকে টেলিফোন আসতো। জানিনা আমাদের নিয়মিত সে কলার এখন কেমন আছেন? ইউক্রেন অনেকদিক থেকে এগিয়ে গেছে এই ক’বছর, রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনে ইউরোপ ও বিশ্বে ইউক্রেন তৃতীয়। রকেট লঞ্চার উৎপাদনে এই দেশটা সারা দুনিয়ায় মধ্যে চতুর্থ। তবে ইরাক যুদ্ধে তারা যেসব দেশের সাথে সরাসরি অংশ গ্রহন করে আর আজ অনেকই তাদের এই tragedy তে নীরব। এক হিসাব মতে ৭,০০০ ইউক্রেনিয়ান সৈন্য ইরাক যুদ্ধে অংশ গ্রহন করে। ৪৬০, ০০০ মানুষ ইরাক যুদ্ধে প্রাণ হারায়।

মার্টিন লুথার কিং এর ভাষায়- "In the end, we will remember not the words of our enemies, but the silence of our friends." ইউক্রেন যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কতো যে প্রাণহানীদোর ঘটবে তা কে জানে? ১৯৩৯ সালে চেকোস্লোভাকিয়া দখল করার পর হিটলাররের নাৎসীরা হাজার হাজার মানুষের উপর অত্যাচারের স্ট্রিম রোলার চালায়। হয়তো পুতিনও তাই করবেন। তবে আমরা অত্যাচারিতের পক্ষ নেবো। Tyrant দের পক্ষ নেয়া মোটেই ঠিক হবে না।

যেমন কবি দিলওয়ার লিখেছেন,

“কাটা তার গোঁফে রেখে আংগুল
একদিন হিটলারও ভাবতেন/
নেই আর নেই তার জার্মান জাতটার
পৃথিবীতে নেই কোনো তুলনা/
ঈশ্বর তুমিও তা ভুলো না।
.. বুট আর বেয়নেট থাকলে/
ঈশ্বরও সাড়া দেয় ডাকলে!”

কিন্তু হিটলার ভুল করেছিলেন। বুট আর বেয়নেটে কাজ হয়নি, তা প্রমানিত। এ ভুলের শিক্ষা পুতিন সম্ভবত নিতে নারাজ। তবে আজ সে জার্মান জাতটা খুব একটা কিছু করতে পারবে না তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। দেশের শতকরা ৫৫%গ্যাস সাপ্লাই তো মস্কো থেকেই যে আসে…

বিলেত অবশ্য কিছু রাশিয়ার উপর কিছু Sanction আরোপ করেছেন, দেখার পালা এগুলো কাজ করে কিনা। If those sanctions don’t work then WW3 is eminent.

লেখক

আবু সাঈদ আনসারী

টিভি ব্যক্তিত্ব, শারীয়াহ কনসাল্ট্যানট, HFA.
চ্যাপলেইন, মিনিস্ট্রি অব জাস্টিস।
ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২২।। লন্ডন, ইউ কে।

এখানে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব, জাস্ট নিউজ বিডি ডটকম’র সম্পাদকীয় বিভাগের আওতাভুক্ত নয়।