সেলফি-রাজনীতি, উন্নয়ন ও আলু-পেঁয়াজের দাম

সেলফি-রাজনীতি, উন্নয়ন ও আলু-পেঁয়াজের দাম

ড. আমিনুল ইসলাম

গত কয়েক দিনে দেশের গণমাধ্যমগুলোয় বেশ কিছু বিষয় আলোচিত হয়েছে। নির্বাচন যত সামনে এগিয়ে আসছে, সরকার চেষ্টা করছে হাতে থাকা প্রকল্পগুলো দ্রুত শেষ করে জনগণের কাছে তাদের সাফল্য তুলে ধরতে। এটি মোটেই অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। যেকোনো রাজনৈতিক দলই চাইবে সরকারে থাকা অবস্থায় তাদের সাফল্য তুলে ধরতে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটা অংশ খুলে দেওয়া হয়েছে। ১০ মিনিট শব্দটা এর পর থেকে বেশ আলোচিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ১০ মিনিটেই বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট চলে যাওয়া যাচ্ছে।

এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দেওয়ার পরপরই আলোচিত হয়েছে পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচলের বিষয়টি। ভিডিওতে দেখা গেছে, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাচ্ছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সরকার চাইছে, তাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সাফল্য নির্বাচনের আগে তুলে ধরতে। স্বাভাবিকভাবে এমনটাই আসলে হওয়ার কথা। যেকোনো সরকারই চাইবে সরকারে থাকা অবস্থায় তারা কোন কোন জায়গায় সফল হতে পেরেছে, সেগুলো যেমন তুলে ধরতে, তেমনি ভবিষ্যতে তারা কী কী করতে চায়, তার একটা রোডম্যাপও হয়তো তুলে ধরার ব্যাপার আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এই সাফল্যগুলো কি সত্যিই সাফল্য হিসেবে ধরা দিচ্ছে?

দেশে বেশ কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন যে হয়েছে এবং এর সুবিধা যে দেশের জনগণ পাচ্ছে, এটি অবশ্য অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু একই সঙ্গে এটিও বলতেই হচ্ছে, সরকার যখন এসব উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করছে, সেই মুহূর্তে দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষকে কখনো ডিমের দাম নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে, কখনো কাঁচা মরিচের দাম, আবার কখনো আলুর দাম নিয়ে! কারণ, এক রাতের মধ্যেই কখনো তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে তো চিনির নাম দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে! 

যাদের তিন বেলা খাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে, তাদের কাছে কি এসব উন্নয়নের কোনো মানে আছে?

এত এত উন্নয়ন হচ্ছে। এত বড় প্রকল্প হচ্ছে। তাহলে সাধারণ মানুষকে কেন দৈনন্দিন জীবনের জিনিসপত্রগুলো কিনতে হাঁসফাঁস করতে হচ্ছে?

সাধারণ জনগণ রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ বোঝে না। বুঝতে চায়ও না। তারা চায় দুবেলা ভালোভাবে খেয়ে পরিবার নিয়ে একটু ভালোভাবে বাঁচতে। সেই ভালোভাবে বাঁচা কি তাদের পক্ষে এক জীবনে সম্ভব হবে? তারা এসব প্রশ্নের উত্তর নিজেরাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। যখন তারা দেখে একদিকে উন্নয়ন হচ্ছে, আরেক দিকে খবর বের হচ্ছে, সরকারের আমলা, পুলিশের ওসিসহ অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি ও সম্পদ গড়ে তুলছেন, তখন তারা যোগ-বিয়োগ করে। সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করে, কেন তারা দুই বেলা ভালোভাবে খাবার জন্য তেল-নুন কিনতে পারছে না। কেন তাদের জীবনের ভাগ্যের চাকা না ঘুরলেও একটা শ্রেণির ভাগ্য কিন্তু ঠিকই বদলে যাচ্ছে।

সরকারকে বুঝতে হবে, যত বড় অবকাঠামোগত উন্নয়নই হোক, সেখানে যদি জবাবদিহি না থাকে, সেখানে যদি দুর্নীতি থাকে; তাহলে সেই উন্নয়ন কোনো দিনই সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবে না। যাদের খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে, তারা নিশ্চয় মেট্রোরেলে চড়ে আনন্দ নিতে যাবে না। তাই এসব উন্নয়নে তারা নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছে না। জনগণ তখনই নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারবে, যখন তারা দেখবে তাদের প্রতিদিনের জীবনে পরিবর্তন এসেছে। তারা সহজে চাল-ডাল, তেল-আলু কিনতে পারছে। দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকতে পারছে।

সবার আগে মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে হবে। যেখানে খাদ্যের নিরাপত্তা নেই, যেখানে মাথা গোঁজার জায়গা নেই, যেখানে চিকিৎসার সুযোগ নেই, সেখানে এক্সপ্রেসওয়ে কিংবা মেট্রোরেলকে তাদের কাছে বিলাসিতা মনে হওয়াও কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নয়। সরকারকে ভাবতে হবে, তারা আদৌ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে কি না? নির্বাচন এলেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সেই চেষ্টাটা আসলে পুরো বছর জারি রাখতে হবে। নইলে জনগণের সঙ্গে যে দূরত্ব তৈরি হয়, সেই দূরত্ব কিন্তু দুই মাসে ঘুচিয়ে ফেলা সম্ভব নয়।

একটা উদাহরণ দিয়েই বরং ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলা যাক। নির্বাচন সামনে হওয়ায় দেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত কিংবা অন্য দেশগুলোর সম্পৃক্ততা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এর আগে ঘোষণা করেছিল, বাংলাদেশের যারাই সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দেবে, তাদের ওপর তারা ভিসা অবরোধ দেবে। এই নিয়ে এরপর দেশের রাজনীতিবিদেরা নানা আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। সরকারদলীয় পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রে যেতে হবে কেন? পৃথিবীতে কি আর কোনো দেশ নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র যে হস্তক্ষেপ করছে, এটি তাদের পছন্দ হচ্ছিল না। কিন্তু এরপর আমরা কী দেখলাম?

দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর কন্যাসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সেলফি তুলেছেন জি-২০ সম্মেলনে গিয়ে। যে-কেউ যে কারও সঙ্গে সেলফি তুলতেই পারে। এটি তো অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়, কিন্তু সরকার দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী যখন ওই সেলফিকে উদ্দেশ করে বলেন, বিরোধী দলের তো এখন হুঁশ থাকবে না, কিংবা এই ধরনের কিছু কথাবার্তা। তখন নিশ্চয় দেশের সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, একই দল কিছুদিন আগে বলেছে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা না দিলে কোনো সমস্যা নেই। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও আরও অনেক দেশ আছে। 

সেই দলেরই সাধারণ সম্পাদক এখন সামান্য একটা সেলফি দেখিয়ে যেভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন, তাতে জনগণের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, সরকার যা বলে, সেটা তারা নিজেরা আদৌ বিশ্বাস করে তো? আর যা করে, সেটা কি তারা সত্যিই জনগণের জন্য করে?

লেখক: ড. আমিনুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি। 

এখানে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব, জাস্ট নিউজের সম্পাদকীয় বিভাগের আওতাভুক্ত নয়।