অপরাধ জগতের ডন কালা ফিরোজ

অপরাধ জগতের ডন কালা ফিরোজ

কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ ওরফে কালা ফিরোজ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার অপরাধজগতের নানা কানেকশন একের পর এক বেরিয়ে আসছে। ঢাকার অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসীর ঘনিষ্ঠ এই কালা ফিরোজ ক্যাসিনোকান্ডে গ্রেপ্তার যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জিকে শামীমেরও কাছের মানুষ। অভিযোগ রয়েছে, এ দুই যুবলীগ নেতার টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচারে সহায়তা করতেন ফিরোজ। এ ছাড়া বিদেশে পলাতক কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর কাছে টাকার ভাগ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও ছিল তার। এ ব্যাপারে ফিরোজকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে একের পর এক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে।

একাধিকসূত্রে এ তথ্য জানা গেছে, এক যুগ আগেও অপরাধজগতে ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে শফিকুল আলম ফিরোজ ‘কালা ফিরোজ’ নামে পরিচিত ছিলেন। খুন, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, মানবপাচার ও স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত তিনি। সময়ের পালাবদলে অপরাধ জগতের এই ত্রাস বিএনপি থেকে রাতারাতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বনে যান। এ ছাড়া তিনি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সিনিয়র সহসভাপতি হন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চাঁদপুর-৫ (শাহরাস্তি-হাজীগঞ্জ) আসনে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পেতেও তিনি ব্যাপক তদবির চালিয়েছিলেন। জানা গেছে, ১৯৮১ সালে কয়েকটি মামলার আসামি হওয়ার কারণে সৌদি আরবে পাড়ি জমান ফিরোজ। কয়েক বছর পর দেশে ফিরে মধ্যপ্রাচ্যে লোক পাঠানোর কাজ শুরু করেন। একসময় তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে বিএনপির তৎকালীন এমপি এমএইচ সেলিম ওরফে সিলভার সেলিম ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে। তাদের হাত ধরেই যুক্ত হন বিএনপির রাজনীতিতে। সেই সময় বিদেশ পাঠানোর নামে কয়েক হাজার মানুষকে নিঃস্ব করার অভিযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে ওই সময় ফিরোজ জড়িয়ে পড়েন স্বর্ণ চোরাচালানেও।

সূত্র জানায়, ফার্মগেট এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি হান্নানের সঙ্গে একসময় সখ্যতা ছিল ফিরোজের। কিন্তু ২০০৫ সালে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে হান্নান নিহত হলে কিছু দিন গা ঢাকা দেন ফিরোজ। কিন্তু কিছু দিন পরই তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের সবুজ সংকেত পেয়ে আবার সক্রিয় হন ফিরোজ। এর পর জনশক্তি রপ্তানি ব্যবসা করার সূত্রে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলামের ভগ্নিপতি নুরুল ইসলামের সঙ্গে সম্পর্ক হয় তার। সেই সুবাদে হুন্ডি ব্যবসা ও রাজধানীর গুলশানের ফু ওয়াং ক্লাবের অনুসরণে কলাবাগান ক্লাবে জুয়া চালু করেন।

আরও কয়েকটি সূত্র বলছে, ফিরোজ কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে বন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজিদুল ইসলাম ইমন ও বিদেশে পলাতক তানভিরুল ইসলাম জয়ের হয়ে কাজ করছিলেন। কৃষক লীগ করলেও বিএনপির সঙ্গেও তার সুসম্পর্ক রয়েছে। ধানম-ি বিএনপির এক শীর্ষ নেতা এবং যুবলীগ উত্তরের এক নেতার সহযোগিতায় তিনি শীর্ষ সন্ত্রাসী জয় ও ইমনের হয়ে চাঁদাবাজি দেখভাল করতেন। ফিরোজই সন্ত্রাসী ইমনের চাঁদাবাজির ক্যাশিয়ার ছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। শুধু জয় বা ইমন নয়, একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মুরগি মিলনসহ অনেকের সঙ্গেই ফিরোজের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। জনশক্তি রপ্তানির আড়ালে তিনি মূলত আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভয়ঙ্কর ডনদের সঙ্গে মিলেমিশে রাজধানীর সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৬ সালের ১৪ মে সন্ধ্যায় পরীবাগের জনশক্তি রপ্তানি ও ট্রাভেলস এজেন্সি ‘দ্য তুর্কি অ্যাসোসিয়েটসে’ চাঁদা না দেওয়ায় এলোপাতাড়ি গুলি চালানো হয়। এতে একজন নিহত এবং ছয়জন গুলিবিদ্ধ হন। এ ঘটনায় রমনা থানার ওই হত্যা মামলার দুই নম্বর আসামি কালা ফিরোজ। এ ছাড়া এ মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছিল ফিরোজের ভাই শমসের আলম নসুকে। দ্য তুর্কি অ্যাসোসিয়েটসের তৎকালীন নিরাপত্তা কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আলম মামলাটি করেছিলেন। মামলায় বলা হয়, চাঁদাবাজি ও ব্যবসায়িক বিরোধের জেরে শীর্ষ সন্ত্রাসী জয়ের হয়ে তার সহযোগীরা ও কালা ফিরোজ ওই হামলা চালায়।

জানা যায়, ২০০০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আন্ডারওয়ার্ল্ডের এক সময়ের ভয়ঙ্কর ডন হুমায়ুন কবির ওরফে মুরগি মিলন আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে বের হলে প্রকাশ্যে তাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। এ ঘটনায় কলকাতা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দেশে ফিরিয়ে আনে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে ইমন জানিয়েছিল, মুরগি মিলন একজন যুবলীগ নেতার আশীর্বাদপুষ্ট ছিল। ফলে ওই সময়ে মিলন বিমানবন্দর থেকে গোটা রাজধানীর অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করত। এ কারণে যুবদলের এক প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা সেভেন স্টার বাহিনী ও স্বর্ণ চোরাকারবারী চক্র কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এসব কারণেই কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর সমন্বিত পরিকল্পনায় হত্যা করা হয় মিলনকে। আর এই হত্যাকা-ের ব্যয় হিসেবে স্বর্ণ চোরাচালানিরা ৬০ লাখ টাকা খরচ করেছিল। এই টাকা সন্ত্রাসীদের পক্ষে গ্রহণ করেছিলেন এই কালা ফিরোজ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র আরও জানায়, জনশক্তি রপ্তানি, হুন্ডি ও ক্যাসিনো ছাড়াও কালা ফিরোজের অন্যতম ব্যবসা ছিল ইয়াবাবাণিজ্য। ঢাকার প্রায় সব ক্যাসিনোতে এবং প্রভাবশালী যুবদল ও যুবলীগ নেতাদের কাছে ফিরোজ ইয়াবা সরবরাহ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে সম্প্রতি ফিরোজের গ্রেপ্তারের ঘটনায় অনেকটা হতভম্ব অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি। এরই মধ্যে গা ঢাকা দিয়েছে খালেদ ও শামীমের মতো কালা ফিরোজের সহযোগীরাও। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, ফিরোজের মতো অপরাধ জগতের ব্যক্তিদের সাধারণ যে বৈশিষ্ট্যটি মিলে যায়, তা হচ্ছে এরা সর্বদলীয় ব্যক্তি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি যখন যে দলই আসুক না কেন স্রোতে ভেসে সরকারি দলে এরা আশ্রয় নেয়। টাকার জন্য জামায়াত নেতাদের সঙ্গে আপস করতেও কোনো সমস্যা হয় না তাদের।

এমজে/