কারাগারে, বিদেশে থেকেও তারা মামলার আসামি

কারাগারে, বিদেশে থেকেও তারা মামলার আসামি

একসময় ছাত্রদলের রাজনীতি করতেন রাজীব শিকদার। এক দশক ধরে তিনি বাহরাইনে থাকেন। চলতি বছরের জুনে তিন মাসের ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলেন। ছুটি শেষে গত ১১ সেপ্টেম্বর আবার বাহরাইনে ফিরে যান। কিন্তু ২ নভেম্বর মাগুরার মহম্মদপুর থানায় নাশকতা ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে পুলিশের করা একটি মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শেখ শামিম ও ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সাইফুল আলম খান। বিশেষ ক্ষমতা আইনে পুলিশের করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে গত ২৬ অক্টোবর থেকে কারাগারে আছেন। ৩১ অক্টোবর টঙ্গী পশ্চিম থানায় করা একটি মামলায় তাদের দুজনকে আসামি করা হয়েছে।

কারাগারে কিংবা বিদেশে থাকার পরও মামলার আসামি করাকে পুলিশি হয়রানি বলছেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। বিএনপি বলছে, এটা গায়েবি মামলার আরেক উদাহরণ।

তবে পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থল থেকে আটক ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাঁদের আসামি করা হয়েছে। তদন্তে পরবর্তী সময়ে তাঁদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া না গেলে আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হবে।

কারাগারে থেকেও আসামি
২৬ অক্টোবর বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হন বিএনপির নেতা শেখ শামিম ও সাইফুল আলম খান। বর্তমানে তারা কারাগারে আছেন। ৩১ অক্টোবর টঙ্গী পশ্চিম থানায় তারাসহ ৭৮ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা ৫০-৬০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আইন উদ্দিন। মামলায় শামিম ২১ নম্বর ও সাইফুল ৫২ নম্বর আসামি। অভিযোগে বলা হয়, ৩০ অক্টোবর রাতে বিএনপি ও জামায়াতের

১৩০ থেকে ১৪০ নেতা-কর্মী ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গীর কলেজ গেট এলাকায় জড়ো হয়ে একটি মোটরসাইকেলে আগুন দেন এবং সড়কে থাকা গাড়ি ভাঙচুর করতে থাকেন। পুলিশ এগিয়ে গেলে তাঁরা ইটপাটকেল ছোড়েন। পুলিশ তাঁদের ধাওয়া দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে ছয়জনকে আটক করে।

গাজীপুর মহানগর কোর্ট পরিদর্শক মো. মিজানুর রহমান খান বলেন, ২৬ অক্টোবর নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন সরকারের বাড়ি থেকে ৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। ওই ৫৭ জন এখনো কারাগারে আছেন। তাদের মধ্যে শেখ শামিম ও সাইফুল আলম আছেন।

মামলার বাদী এসআই মো. তাইম উদ্দিন এ ব্যাপারে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, তদন্তে কারও সংশ্লিষ্টতা না পাওয়া গেলে অবশ্যই তার নাম বাদ দেওয়া হবে।

সাইফুল-শামিমের রাজনৈতিক সহকর্মী ও টঙ্গী পশ্চিম থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি শেখ মো. আলেক বলেন, ২৬ অক্টোবর ঘরোয়া বৈঠক থেকে শামিম ও সাইফুলকে আটক করে পুলিশ। এর পর থেকে তারা কারাগারে। কিন্তু পুলিশ গাড়ি পোড়ানোর মামলায় তাদের আসামি করেছে।

মামলার এজাহার অনুযায়ী আগুন দেওয়া মোটরসাইকেলটি (নম্বর ঢাকা মেট্রো-হ ২৬৪৩০৮) জব্দ করে রাখা হয়েছে টঙ্গী পশ্চিম থানায়। গতকাল বুধবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, মোটরসাইকেলটি অনেকটা রংচটা। কোথাও কোথাও মরিচা ধরা, আসনের (সিট) কিছু অংশ পোড়া।

গাজীপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মোটরসাইকেলটির মালিকের নাম শাহাদাত হোসেন। তার বাসা রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ১০ নম্বর সড়কে। বেলা দুইটার দিকে মালিকের বাসায় গিয়ে এ নামে কাউকে পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা টঙ্গী পশ্চিম থানার উপপরিদর্শক উৎপল কুমার সাহা বলেন, ‘আমরা সেদিন খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে মোটরসাইকেলটিতে আগুন জ্বলা অবস্থায় পাই। মোটরসাইকেলটি সেখানে কীভাবে এল বা মালিক কে—এসব বিষয়ে এখনো জানা যায়নি। এসব বিষয়ে তদন্ত চলছে।’

৩ সাক্ষীর ২ জনই ছাত্রলীগ নেতা, দেখেননি ঘটনা
মামলার এজাহারে মো. শফিক, দ্বীন মোহাম্মদ কাউসার হোসেন নীরব ও মো. মহিউদ্দিন নামের তিনজনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে মো. শফিক টঙ্গী পশ্চিম থানা ছাত্রলীগের সভাপতি, দ্বীন মোহাম্মদ কাউসার হোসেন নীরব একই থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। আর মহিউদ্দিন থানার কনস্টেবল।

যোগাযোগ করা হলে মো. শফিক বলেন, ‘মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া বা গাড়ি ভাঙচুরের বিষয়ে আমার জানা নেই। গত ১৫ দিনেও আমার চোখের সামনে এমন ঘটনা পড়েনি।’ তাহলে মামলার এজাহারে নাম এল কীভাবে জানতে চাইলে তিনি পরে কথা বলবেন জানিয়ে ফোন কেটে দেন।

দ্বীন মোহাম্মদ কাউসার হোসেন নীরব বলেন, ‘আমরা আগুনের কথা শুনে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। পরে এ বিষয়ে আমরা টঙ্গী পশ্চিম থানায় গেলে পুলিশ আমার সাক্ষ্য নেয়। তবে আমি নিজ চোখে এমন কিছুই দেখিনি।’

টঙ্গী পশ্চিম থানা-পুলিশের কনস্টেবল মো. মহিউদ্দিন প্রথমে এমন কোনো ঘটনা ঘটার বিষয় মনে করতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে মামলার সাক্ষীর বিষয়ে উল্লেখ করা হলে তিনি মোটরসাইকেলে আগুন বা গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে বলে জানান।

প্রবাসে থেকেও আসামি
হজ-ওমরাহর লোক আনা-নেওয়ার কাজ করেন মো. মকবুল হোসেন। তিনি গাজীপুর সিটির ৫২ নম্বর ওয়ার্ড জামায়াতের সাবেক আমির। ২২ অক্টোবর থেকে তিনি সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। কিন্তু ২ নভেম্বর টঙ্গী পশ্চিম থানায় গাড়ি ভাঙচুরের একটি মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। ওই মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ১ নভেম্বর রাতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চেরাগ আলী এলাকায় জামায়াতের ৭০-৮০ নেতা-কর্মী জড়ো হয়ে গাড়ি ভাঙচুর করতে থাকেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তারা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছোড়েন। পুলিশ ধাওয়া দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে কয়েকজনকে আটক করে। অন্যরা পালিয়ে যান। মকবুল হোসেন মামলার ১৪ নম্বর আসামি।

তবে স্থানীয় কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মকবুল গত ২২ অক্টোবর সৌদি আরবে যান। তিনি এখনো সেখানেই অবস্থান করছেন। মকবুলের ভাই মানিক হোসেন দাবি করেন, ‘আমার ভাই সেভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। হজের কাজে বিদেশ গেছেন। এরপরও তাকে আসামি করা হয়েছে।’

রাজীবের বাহরাইনে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে প্রথম আলো। রাজীব মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি যখন দেশে ছিলাম, তখন ছাত্রদলের রাজনীতি করতাম। এ কারণেই হয়তো কেউ শত্রুতামূলকভাবে আমার নাম দিয়েছে।’ রাজীবের বাবা বাদশা শিকদার প্রশ্ন তোলেন, দুই মাস আগে বাহরাইন চলে যাওয়া ছেলেকে কীভাবে আসামি করা হলো।

মামলার বাদী টঙ্গী পশ্চিম থানার এসআই মো. আবদুল আউয়ালের ভাষ্য, ‘আমরা ঘটনাস্থল থেকে ১১ জনকে ধরেছিলাম। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অন্যদের নাম দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে সবকিছু যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না। কেউ যদি ঘটনাস্থলে না থাকে বা সংশ্লিষ্টতা না পাওয়া যায়, তবে অবশ্যই চার্জশিট থেকে তাদের নাম বাদ যাবে।’

মকবুলের মতো বাহরাইনে থাকেন মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলা সদরের বাদশা শিকদারের ছেলে রাজীব শিকদার। ২ নভেম্বর মহম্মদপুর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে একটি মামলায় তাঁকে আসামি করেছে পুলিশ। এসআই মো. মুস্তাফিজুর রহমান ১৯৯ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামা ১০০ থেকে ১৫০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলায় রাজীব শিকদারকে ১৭৮ নম্বর আসামি করা হয়।

মামলায় উল্লেখ করা হয়, বাদী ১ নভেম্বর রাতে মহম্মদপুর বাজারে টহল দেওয়ার সময় খবর পান, বিএনপির নেতা-কর্মীরা নাশকতা করতে মাগুরা-মহম্মদপুর সড়কের ধোয়াইল আদর্শ নুরানি হাফেজি মাদ্রাসার সামনে জড়ো হয়েছেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল বিস্ফোরণ করে পালিয়ে যান।

৬ নভেম্বর ঘটনাস্থলের আশপাশে বাড়ি এমন চারজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১ নভেম্বর রাত ১১টা ৩০ মিনিট থেকে পরবর্তী এক ঘণ্টা পর্যন্ত ওই স্থানে কোনো মানুষের জমায়েত বা বোমা বিস্ফোরণের শব্দ কেউ শোনেননি। তবে রাত দুইটার দিকে কয়েকটি বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। কিন্তু মানুষের জমায়েত হওয়ার কোনো ঘটনা তাঁরা জানেন না।

মামলার সাক্ষী করা হয়েছে মো. বাবুল শেখ ও কাবুল শেখ নামের দুই ব্যক্তিকে। জানতে চাইলে তারা বলেন, রাত দুইটার দিকে যখন বোমা বিস্ফোরণের শব্দ হয়, তখন তারা ঘুমাচ্ছিলেন। বোমার শব্দ শুনলেও ভয়ে তারা কেউই ঘর থেকে বের হননি। পুলিশ তাদের ডেকে তোলে। পরে তাদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেওয়া হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যে হচ্ছে, দেশে অপরাধ যাতে না হয়, হলে বিচারে শাস্তির ব্যবস্থা করা। এখন ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যে হয়েছে যে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য পরিবর্তনের কারণে এসব অপপ্রয়োগ হচ্ছে। এর ফলে দেশের নাগরিকদের সংবিধান প্রদত্ত সব মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এক অর্থে আমরা নাগরিক থেকে আবার প্রজায় পরিণত হয়ে যাচ্ছি।’-প্রথম আলো