প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কে আমেরিকানরা হতাশ

প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কে আমেরিকানরা হতাশ

যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশেষ সংবাদদাতা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত প্রথম প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্ক আশা জাগাতে পারেনি আমেরিকানদের। বিতর্ক অনুষ্ঠানের পর পর একে অত্যন্ত নিম্নমানের বিতর্ক হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন দেশটির অনেক সচেতন ভোটার।

প্রথমবার বিতর্কে মুখোমুখি হয়েছিলেন রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন। মঙ্গলবার রাতে ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ক্লিভল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এ বিতর্ক অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন উপস্থাপক ক্রিস ওয়ালেস।

বিতর্কে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যথারীতি গলাবাজির মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করলেও জোবাইডেন ছিলেন অনেকটা ভাবলেশহীন। বরং তিনি ক্যামেরার সামনে মুখ করে সরাসরি ভোটারের মনোযোগ আকর্ষণ চেষ্টা করেছেন। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ‘কুকুর ছানা’ ‘ক্নাউন’ কিংবা ‘সাটআপ’ বলতেও ছাড়েননি জো বাইডেন।

৯০ মিনিটের বিতর্কে স্থান পায় মূলত ৬ টি বিষয়- সুপ্রিম কোর্ট, করোনাভাইরাস, বর্ণবৈষম্য, নির্বাচন এবং অর্থনীতি।

বিতর্কে দুই নেতার মধ্যে আক্রমণটা এরকম ছিলো যে, বাইডেনতো বলেই দিলেন, "আপনি আমার দেখা যুক্তরাষ্ট্রের এ যাবতকালের সবচেয়ে খারাপ প্রেসিডেন্ট।" সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা জবাবে ট্রাম্প বলেন, "আপনার মধ্যেও তো কোন স্মার্টনেস খুঁজে পাইনা আমি।"

প্রেসিডেন্টের ট্রাম্পের বিপক্ষে বর্ণবৈষম্য তৈরি করে বিভাজন ছড়ানোর অভিযোগ আনেন বাইডেন। তিনি বলেন, "ট্রাম্পই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বর্ণবৈষম্য তৈরি করে বিভাজন ছড়ান।" এ অভিযোগ নাকোচ করে দিয়ে ট্রাম্প বলেন, "১৯৯৪ সালের ক্রাইম বিলে সমর্থনতো আপনিই দিয়েছিলেন। অথচ বিলটিতে আফ্রিকান আমেরিকানদের ভয়ংকর শিকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।"

জবাবে এ ধরনের কোনো সমর্থন তিনি দেননি বলে জানান বাইডেন। পাল্টা আক্রমণ করে তিনি বলেন, "শিকারীরাতো এখন যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।"

তখন ট্রাম্প বলেন, "আপনি 'আইনশৃঙ্খলা বাহিনী' শব্দটা উচ্চারণের সাহসটাও দেখাতে পারেননি। যদি তেমনটা হতো তাহলে চরম বামপন্থাদের সব ভোট খুইয়ে বসতে হবে এমন একটা ভয় ছিলো।"

স্বাস্থ্য খাত প্রসঙ্গে ডেমোক্রেট প্রার্থী বাইডেনকে পক্ষপাতের অভিযোগ এনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, "দলের সোশালিস্টরা আপনার উপর চড়ে বসেছে। এটা আপনি নিজেও ভালো করে জানেন।"

জবাবে বাইডেন বলেন, "এ মুহূর্তে আমি ডেমোক্রেট।"

এরপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বাইডেন বলেন, "সবাই আপনাকে একজন মিথ্যাবাদী হিসেবে চিনে।"

সুপ্রিম কোর্টের শূন্যস্থান দ্রুত পূরণ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আত্মপক্ষ সমর্থন করে কাজটি যথার্থভাবে করেছেন বলে দাবি করেন। প্রতিপক্ষ বাইডেনকে তিনি পাল্টা চ্যালেঞ্চ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, "ডেমোক্রেটদের কথামতো একের পর এক বিচারক নিয়োগ দিয়ে আপনি কী পারবেন সুপ্রিম কোর্টের ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে?" এরপর বিচারক নিয়োগ দেবার কোনো তালিকা বাইডেনের কাছে থাকলে তা প্রকাশের আহবান জানান ট্রাম্প। কিন্ত বাইডেন সেটা পারবেননা বলে জানান তিনি। তখন অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে বাইডেনকে বলতে শোনা যায়, "আপনি কী চুপ করবেন?"

আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে বাইডেনকে অপর একটি পয়েন্টে বলতে শোনা যায়, "এই ক্লাউনের সঙ্গে কথা বলে পেরে উঠাটা মুশকিল। এই লোকটার বিষয়ে আমাকে মাফ করবেন।" তিনি ট্রাম্পকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের পুতুল বলেও কটাক্ষ করেন।

বিতর্কে দু'জনকে থামাতে এবং সঞ্চলনা করতে গলদঘর্ম হতে দেখা যায় সঞ্চালক ক্রিস ওয়ালেসকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন জো বাইডেনের কথার মধ্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করছিলেন, তখন এক পর্যায়ে তাকে এমন আচরণ করতে বারণ করেন উপস্থাপক ওয়ালেস। তিনি বলেন, "আমি মনে করি জনগণের কাছে আমরা ভালভাবে উপস্থাপিত হতে পারবো যদি দু’জনেরই কথার মধ্যে কম ফোঁড়ন কাটি। আপনাদের কাছে আমি এটা মানতে আবেদন জানাচ্ছি।"

জবাবে ট্রাম্প বলেন, "ঠিক আছে। তাকেও এটা মানতে বলুন।"

ক্রিস ওয়ালেস ট্রাম্পের এ কথার জবাবে বলেন, "খোলাখুলি বলি- আপনি বেশি বিঘ্ন সৃষ্টি করছেন।"

ট্রাম্পের পাল্টা জবাব- "তিনি (বাইডেন) তার চাইতেও বেশী বিঘ্ন সৃষ্টি করছেন।"

বিতর্কে করোনাভাইরাস ইস্যুটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য খুবি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিল এবং শুরুর দিকেই এনিয়ে আলোচনা হয়। করোনাভাইরাসে দুই লাখ মানুষ মারা যাওয়ায় ট্রাম্পের কাছ থেকে ব্যাখ্যা আশা করছিলেন দর্শকরা।

বাইডেন বলেন, "ট্রাম্প এই করোনা ভাইরাস নিয়ে ভীতি সৃষ্টি করেছেন এবং মার্কিনিদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, তার কাছে অর্থনীতিই বড় ছিল। তার দৃষ্টি ছিল স্টক মার্কেটের দিকে।"

তিনি আরো বলেন, "বিভিন্ন রাজ্যকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য খুলে দিয়েছেন ট্রাম্প। এক্ষেত্রে তিনি করোনা মহামারির হুমকিকে উপেক্ষা করেছেন। বহু মানুষ মারা গিয়েছেন। তিনি আরো স্মার্ট না হলে, আরো দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে আরো অনেক মানুষ মারা যাবে।"

এ সময় জো বাইডেনের কথার মধ্যে ‘স্মার্ট’ শব্দের ব্যবহারের বিরোধিতা করেন ট্রাম্প। তিনি জো বাইডেনকে বলেন, "আপনি তো আপনার ক্লাসে গ্রাজুয়েট হয়েছেন সবচেয়ে নিচে অথবা সর্বনিম্ন গ্রেডে। আমার বিষয়ে স্মার্ট শব্দ ব্যবহার করবেন না কখনো। আর কখনো ওই শব্দটি ব্যবহার করবেন না।"

করোনা মহামারির মধ্যে তার গৃহীত পদক্ষেপের পক্ষে অবস্থান নেন ট্রাম্প।

ট্রাম্প বলেন, "পদক্ষেপ না নিলে আরো বহু মৃত্যু হতে পারতো এবং জো বাইডেন ক্ষমতায় থাকলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতো।"

এর জবাবে বাইডেন ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে সরাসরি প্রশ্ন করেন যে তারা ট্রাম্পকে বিশ্বাস করেন কি না।

দীর্ঘ সময় সরকারি দায়িত্বে থাকা জো বাইডেনকে বিতর্কের এক পর্যায়ে ট্রাম্প বলেন, "৪৭ মাসে (ক্ষমতায় থেকে) আমি যা করতে পেরেছি, আপনি ৪৭ বছরে তা পারেননি।"

বাইডেনের জবাব ছিল "এই প্রেসিডেন্টের অধীনে আমরা আরো দুর্বল, অসুস্থ, দরিদ্র ও বিভাজিত হয়েছি।"

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনারোধে মাস্ক পরায় বাইডেনের উৎসাহ নিয়ে কটাক্ষ করে বসেন। তিনি বলেন, "আমার সঙ্গে মাস্ক রয়েছে। যখন প্রয়োজন হয় তখন আমি মাস্ক পরি।" বাইডেনকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, "আমি তার মতো মাস্ক পরি না। যখনই তার দিকে তাকাবেন দেখবেন মাস্ক পরে আছেন।"

কর ফাঁকির অভিযোগ প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেন, তিনি লাখ লাখ ডলার কর দিয়েছেন।

প্রেসিডেনশিয়াল বিতর্কের চূড়ান্ত পর্যায়ের আলোচনা ছিল নির্বাচনের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে। ঐ অংশে দুই পক্ষই আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না।

ট্রাম্পের আশঙ্কা ডাকের মাধ্যমে ভোট দেয়া হলে দুর্নীতির সুযোগ থেকে যায়।

বাইডেন দাবি জানান, সবগুলো ব্যালট যেন গণনা করা হয় এবং নির্বাচনের ফলাফল সব পক্ষ যেনে মেনে নেন। শেষদিকে তিনি আরো কিছু বলতে চাইলেও ট্রাম্প তাকে আবারো বাধা দিলে সঞ্চালক ওয়ালেস বিতর্কের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

আগামী ৩রা নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আর বাকি প্রায় ৫ সপ্তাহ। এর আগে প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্ক অনুষ্ঠিত হলো। দেশটির গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোতে পরিচালিত জরিপ আভাস দিচ্ছে ট্রাম্প এবং বাইডেনের নির্বাচনী লড়াইয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।

জিএস/