মুশতাকের মৃত্যু নাগরিক সমাজে শীতল বার্তা দিচ্ছে: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

মুশতাকের মৃত্যু নাগরিক সমাজে শীতল বার্তা দিচ্ছে: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

 

নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা বাংলাদেশি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু নিয়ে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এ বিষয়ে সংগঠনটির এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস বলেছেন, মুশতাকের মৃত্যু বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের মধ্যে একটি শীতল বার্তা পাঠিয়েছে। শান্তিপূর্ণ সমালোচনার কারণে এরকম আচরণ অবিলম্বে বন্ধ করাতে সরকারকে বাধ্য করা উচিত।

তিনি আরো বলেছেন, ফেসবুকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে নিয়ে স্যাটায়ার বা ব্যঙ্গ করার সমতুল্য হতে পারে না একটি মৃত্যু। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, গত ২৫ শে ফেব্রুয়ারি জেলের ভিতর নিরাপত্তা হেফাজতে মারা যান মুশতাক আহমেদ। এর আগে করোনা ভাইরাস মহামারি নিয়ে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার কারণে বিনা বিচারে তাকে ৯ মাস জেলে আটকে রাখা হয়। গত বছর মে মাসে লেখক মুশতাক আহমেদ, কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে গ্রেপ্তার করে কর্তৃপক্ষ।

এর মধ্যে মুশতাক আহমেদ করোনা মহামারি নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পিপিই’র সঙ্কট নিয়ে সমালোচনা করে একটি লেখা প্রকাশ করেছিলেন। এ ছাড়া তিনি ফেসবুককে ‘আই অ্যাম বাংলাদেশি’ নামে পেইজে করোনা মহামারিতে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে দুর্নীতি নিয়ে কিশোরের আঁকা কার্টুন শেয়ার দিয়েছিলেন। তারপর থেকে মুশতাক আহমেদের পোস্ট সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ফেসবুক পেইজ থেকে কিছু পোস্ট মুছে দেয়া হয়েছে। তাদের জামিন আবেদন বার বার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ‘প্রপাগান্ডা, মিথ্যা ও আক্রমণাত্মক তথ্য এবং ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে ২০১৮ সালের বহুল বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। বলা হয়, এসব তথ্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে। সৃষ্টি করতে পারে অসন্তোষ।

গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি তাদের দু’জনকে আদালতে হাজির করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এ সময় মুশতাক আহমেদকে দেখে মনে হয়েছে তিনি সুস্থ আছেন। শুনানিতে অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার জন্য কিশোরের স্বাস্থ্যগত অবস্থার অবনতি হচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মুশতাক আহমেদ।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আরো লিখেছে, শুনানিতে কিশোর তার আইনজীবীদের বলেছেন, তাকে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। পায়ে এবং কানের ভিতরে ইনফেকশনে ভুগছেন তিনি। তার নির্যাতনের অভিযোগ এবং অপর্যাপ্ত যত্নের অভাব নিয়ে যে তথ্য মিলছে, তা বাংলাদেশে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের হেফাজতে নির্যাতনের একটি প্রামাণ্য ডকুমেন্ট। মুশতাক আহমেদের মৃত্যু সেই অভিযোগের গুরুত্বকে ফুটিয়ে তোলে।

তবে কারা কর্তৃপক্ষ মিডিয়াকে বলেছেন, ২৫ শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় মুশতাক আহমেদ আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় কারা হাসপাতালে। এরপর গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এ নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ আছে যে, মুশতাক আহমেদকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল এবং এ সময় তার হাতে ছিল হ্যান্ডকাফ পরানো।

নিরাপত্তা হেফাজতে মুশতাকের এ মৃত্যুতে বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকায় অবস্থানরত ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোর ১৩টি মিশনের প্রধানরা। তারা আরো উল্লেখ করেছেন, তারা বহুল বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তাদের সরকারের উদ্বেগের বিষয় বাংলাদেশ সরকারের কাছে অব্যাহতভাবে তুলে ধরবেন। বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, জাতিসংঘের নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞরা এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বার বার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সমালোচনা করেছেন। বলা হয়েছে, এই আইন দিয়ে মুক্তভাবে কথা বলাকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। মে মাসে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের ৩১১ জন সদস্য একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে তারা এই আইনের অধীনে যাদেরকে আটক রাখা হয়েছে, তাদেরকে মুক্তি দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী স্বীকার করেছেন যে, এই আইনে সমস্যা আছে। তিনি বলেছেন, দুঃখজনক হলো, আমরা এখন জানতে পেরেছি যে, এর মধ্যে কিছু শব্দ আছে যা অত্যন্ত ঢিলেঢালা এবং অস্পষ্ট। এর ফলে এ আইনটির অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের জেলখানাগুলোতে গাদাগাদি করে থাকেন বন্দিরা। করোনা মহামারি বিস্তারের সময় নিরাপত্তা হিসেবে সরকার মুক্তি দিয়েছে কয়েক হাজার বন্দিকে। তবে সরকারের সমালোচক ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে যেসব অধিকারকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, এর মধ্যে তারা ছিলেন না। তাদেরকে এর বাইরে রাখা হয়েছে। কিশোর এবং মুশতাক আহমেদের জামিন আবেদন ৬ বার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। স্বাস্থ্যগত অবস্থার অবনতিতে মানবিক কারণে কিশোরকে মুক্তি দেয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীনে বাংলাদেশ যেসব বাধ্যবাধকতায় সম্মত তার আলোকে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন তারা। কিশোরের পরবর্তী জামিন আবেদন মার্চের শুরুতে হওয়ার কথা রয়েছে।

ব্রাড এডামস বলেছেন, করোনা মহামারিকালে স্বাস্থ্যকর্মীদের উন্নত সুরক্ষার জন্য শুধু কথা বলার জন্য নিরাপত্তা হেফাজতে মরতে হয়েছে মুশতাক আহমেদকে। এই ধ্বংসাত্মক মুহূর্তে (ডিভাস্টেটিং মোমেন্ট) নাগরিক সমাজ, জাতিসংঘ ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের আহ্বানের প্রতি মনোযোগ দেয়া উচিত বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের। তাদের আহ্বানের প্রতি সাড়া দিয়ে অবিলম্বে ওইসব মানুষকে মুক্তি দেয়া উচিত, যারা বর্তমানে মুক্তভাবে কথা বলার জন্য বন্দি আছেন। একই সঙ্গে মুক্তভাবে মত প্রকাশের অধিকারকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।