সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভস- এ জন ড্যালিনোয়িচের নিবন্ধ

‘স্বৈরতন্ত্রের পথ না ছাড়লে পশ্চিমে একঘরে হবে শেখ হাসিনা সরকার’

‘স্বৈরতন্ত্রের পথ না ছাড়লে পশ্চিমে একঘরে হবে শেখ হাসিনা সরকার’

যতদিন বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার তার বর্তমান রাজনৈতিক পথ ধরে হাঁটবে ততদিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সমমনা দেশগুলো সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশকে খুব কমই ছাড় দিবে। বাংলাদেশ যদি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের সম্পর্ক বাড়াতে চায় এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে চায় তাহলে তাদেরকে স্বৈরতন্ত্রের পথ ছাড়তে হবে। নাহলে বাংলাদেশ পশ্চিমে একটি একঘরে দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওয়াশিংটন সফর নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী এই নিবন্ধটি লিখেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ডেপুটি মিশন প্রধান, কূটনীতিক এবং ‘সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভস-এরএডিটর এ্যাট লার্জ জন ড্যানিলোয়িচ। শনিবার ‘সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভস-এর ওয়েব ভার্সনে এই বিশ্লেষণটি প্রকাশিত হয়।

জাস্ট নিউজ পাঠকদের জন্য বিশ্লেষণটির অনুবাদ নীচে তুলে ধরা হলো:

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক ওয়াশিংটন সফরকে পর্যালোচনা করলে বেশ কিছু বিষয় সামনে চলে আসে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ম্যালপাসের হাতে শেখ হাসিনার পদ্মা সেতুর বাঁধাই করা একটি ফ্রেম হাতে তুলে দেবার কথা বলা যেতে পারে। একদশক আগে দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মাসেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দেবার এই ছবির উপহারটা বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের জন্য হাল্কা কোনাে আঘাত ছিলোনা! আরেক ছবিতে আমরা দেখতে পাই যুক্তরাষ্ট্র চেম্বার অব কমার্সের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে সভাপতিত্ব করছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে বেশি বিনিয়োগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের পুনঃআহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সফর শেষে ঊর্ধ্বতন বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কর্মকর্তারা দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব সংলাপ নিয়েও একপ্রস্থ আলোচনা করেন, ২০১৪ সালে যেটির সূচনা হয়েছিল। এতে কোনো সন্দেহ নাই যে প্রধানমন্ত্রী এবং তার সমর্থকরা যুক্তরাষ্ট্রের এই সফর এবং ছবিগুলোকে সরকারের সাফল্য বলে প্রচার করবে এবং একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে খুব গুরুত্ব দেয় এটা বলে বেড়াবে। তবে, ছবিগুলো থেকে আরও কিছু বিষয় উঠে আসে।

তবে সফরে যে বিষয়টি হাসিনার সমর্থকদের মধ্যে কম গুরুত্ব পাবে সেটি হলে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে যখন বিশ্বব্যাংক হেডকোয়ার্টারে অনুষ্ঠান চলছিলো ঠিক তখনি আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিরোধীদলের কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির তৈরি করে। ওয়াশিংটনের রাজপথে এই যে বিশৃঙ্খলা এটা ভালো কোনো কাজ নয়। বরং এটি বাংলাদেশের ব্যর্থ রাজনীতির চিত্র যেটি দেশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সীমানায় উন্মুক্ত হয়েছে। অন্য যে বিষয়টি জোর দিয়ে বলতে হয়, প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে যে ছবির জন্য মরিয়া ছিলেন, সেটি সম্ভব হয়নি; কারণ দুজনের দেখা হয়নি। যদিও হাসিনা এবং তার সমর্থকরা স্পষ্ট করেই জানেন, এটি কোনো সরকারি সফর ছিল না, কিন্তু নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রী বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করতে পারলে বেজায় খুশি হতেন। এক্ষেত্রে সম্পর্ক যদি ভালোই হতো তাহলে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বাংলাদেশের এ ধরনের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিতো। এটা থেকে এই উপসংহারে আসা যৌক্তিক যে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কর্মকর্তারা যেটা ভাবছেন সেটা হলো- বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এর আগে যে বৈঠকগুলো হয়েছে সেখানে তারা ইতিমধ্যেই মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও এনিয়ে বৈঠক করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন। শেষ কথা হলো, প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মূলব্যান সময় নষ্ট করলে তাতে খুব কমই স্বার্থ হাসিল হতো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগের সফরগুলোতে কতটা লাভ হয়েছে সে হিসেব কষেই হোয়াইট হাউস তাকে কোনো লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয়নি। এবিষয়ে তারা সঠিক সিদ্ধান্তটি নিয়েছে।

বিভিন্ন দেশের অভিজাত শ্রেণীর মতো, বাংলাদেশের গলাবাজরা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের চোখে বাংলাদেশের গুরুত্বকে খাটো করে দেখেছে। একদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ, সুদানে সংঘাত, এগুলো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে বাইডেন এবং তার কর্মকর্তারা ওয়াশিংটনে হাসিনার সফরকে পাত্তাই দেয়নি। সামনের দিনগুলোতে দেখা যাবে ঢাকার পন্ডিতেরা হাসিনার জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য সফরকে হয় আন্তর্জাতিক সমর্থন হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করবে নয়তো বর্তমান সরকারের (বিরুদ্ধে) নিন্দা জানানোর জন্য ব্যবহার করবে।

সমালোচকরা নিজেদের বক্তব্য প্রমাণের জন্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং অন্যদের বিবৃতিগুলো বিশ্লেষণ করবেন। তবে যে সত্য খবরটি তারা প্রচার করবেনা সেটি হলো-বাংলাদেশ এবং তার প্রধানমন্ত্রী ততটা গুরুত্বপূর্ণ নন, যতটা তারা মনে করেন।

বাংলাদেশের যারা ভালো ভবিষ্যতের আশায় আছেন, তারা এই বাক্য থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। যা একই সঙ্গে সহজ এবং গুরুত্বপূর্ণ। যতদিন বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার তার বর্তমান রাজনৈতিক পথ ধরে হাঁটবে ততদিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সমমনা দেশগুলো সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশকে খুব কমই ছাড় দিবে। বাংলাদেশ যদি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের সম্পর্ক বাড়াতে চায় এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে চায় তাহলে তাদেরকে স্বৈরতন্ত্রের পথ ছাড়তে হবে। নাহলে বাংলাদেশ পশ্চিমে একটি একঘরে দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে। এই বার্তাটা যত দ্রুত উপলব্দি করা যাবে তত দ্রুত বাংলাদেশ এবং তার শুভাকাংখীদের জন্য মঙ্গলজনক হবে।

এমএন/