বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন একটি এসিড টেস্ট, নিরপেক্ষ পরিবেশ এবং ডায়লগ জরুরি: যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল

বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন একটি এসিড টেস্ট, নিরপেক্ষ পরিবেশ এবং ডায়লগ জরুরি: যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল

বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে এসিড টেস্ট হিসেবে উল্লেখ করে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের পরিবেশ নিশ্চিত করার আহবান জানিয়েছে। একইসঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সংলাপ আয়োজন করা জরুরি বলে মন্তব্য করেছে পর্যবেক্ষক দলটি।

ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) ও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) সমন্বয়ে গঠিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলটি গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করে। সফর শেষে নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে পর্যবেক্ষক দলের মূল্যায়ন তুলে ধরে শনিবার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)। রিপোর্টে বাংলাদেশের নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে এই মন্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে সরকার, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশনসহ অংশীজনদের কাছে পাঁচটি সুপারিশ উত্থাপন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলটি।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানোর বিষয়টি মূল্যায়ন করতে ৭ অক্টোবর ঢাকায় এসেছিল প্রতিনিধিদলটি। ঢাকা সফরকালে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে প্রতিনিধিদলটি। এ ছাড়া তারা নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করে।

প্রতিনিধিদলে ছিলেন ইউএসএইডের সাবেক ডেপুটি এডমিনিস্ট্রেটর বোনি গ্লিক (আইআরআই সহসভাপতি), দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ল এফ ইনডারফার্থ (এনডিআই সহসভাপতি), মালয়েশিয়ার প্রতিনিধি পরিষদের সাবেক সদস্য মারিয়া চিন আবদুল্লাহ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাবেক এসোসিয়েট কাউন্সেল জামিল জাফের, আইআরআইয়ের সিনিয়র পরিচালক (এশিয়া প্যাসিফিক ডিভিশন) জোহানা কাও এবং এনডিআইয়ের আঞ্চলিক পরিচালক (এশিয়া প্যাসিফিক) মানপ্রীত সিং আনন্দ।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ একটি সন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছে। দেশটির আসন্ন নির্বাচন গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি অঙ্গীকারের একটি চুড়ান্ত পরীক্ষা।”

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলটির উত্থাপিত পাঁচটি সুপারিশ হলো:

১. সহনশীল বক্তৃতা ও নির্বাচনী মুখ্য ইস্যুতে খোলামেলা-অর্থবহ সংলাপে বসা।

২. মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষা, নাগরিক সমাজের অধিকার নিশ্চিত করা, যেখানে ভিন্নমতাবলম্বীদের সম্মান দেখানো হবে।

৩. অহিংস থাকার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে এবং রাজনৈতিক সহিংসতাকারীদের জবাবদিহিতায় আনতে হবে।

৪. সব দলকে অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এর মধ্যে থাকবে স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা।

৫. নাগরিকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সক্রিয় নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করা।

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সুপারিশ প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়েছে, “এসব সুপারিশ একটি রোডম্যাপ, যা নির্বাচনের আগে এবং পরে বিশ্বাসযোগ্য, সবার অংশগ্রহণমূলক, প্রতিদ্বন্দ্বী এবং অহিংস নির্বাচনের দিকে অগ্রগতি অর্জনে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেবে।”  

রিপোর্টে বলা হয়েছে, নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য এবং বৈধ হবার বিষয়টিতে বাংলাদেশের জনগণকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

নির্বাচন কমিশনের সুষ্ঠু ভোট আয়োজন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে রিপোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, “বাস্তবিকভাবে প্রতিনিধিদল যেটা জানতে পেরেছে সেটা হলো- নির্বাচনের দিন কোন সমস্যা হলে সেটা স্বাধীনভাবে সমাধান করার কোনো ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। তারা নির্বাচন এবং আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কোনো নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে পারেনা। ভোট দেওয়া এবং গণনায় রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রটা এভাবেই শুরু হয়। নির্বাচনের সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের আস্থা কমে আসে। কার্যকর এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বের জায়গাটাতে এভাবে অস্পষ্টতা তৈরি হয়।”

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বলেছেন, তারা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা এবং বিরোধী দলের যেসকল নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তারা সবাই নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

প্রতিনিধিদলের উত্থাপিত সুপারিশের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে কথাবার্তায় উদার হওয়া উচিত। অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের বৈধতাকে স্বীকার করতে হবে। মেনে চলতে হবে আচরণবিধি। বর্তমানে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে আপসের জন্য খোলা মনে সমঝোতায় যুক্ত হওয়া উচিত রাজনৈতিক দলগুলোকে। সৃষ্টি করতে হবে বাস্তব, টেকসই ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবর্তন।

সব রাজনৈতিক দল, সরকারের বিভিন্ন অংশ এবং বাংলাদেশ ইস্যুতে সমালোচনামূলক রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকতে হবে সাংবাদিক ও মিডিয়া আউটলেটকে। নাগরিকদের স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করতে দেয়া উচিত। উভয়ক্ষেত্র প্রতিশোধ নেয়ার আতঙ্কমুক্ত থাকতে হবে। যারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক ইস্যুতে কাজ করে তারাসহ নাগরিক সমাজের সংগঠন ও কমিউনিটি ভিত্তিক সংগঠনকে তাদের কর্মকাণ্ড খর্ব করা বা সীমিত করার হুমকির মুখে ফেলা উচিত হবে না। নতুন পাস হওয়া সাইবার নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার বা এই আইন লঙ্ঘন করা উচিত হবে না। এর মধ্যে আছে ভিন্ন মতাবলম্বীদের বক্তব্যের কারণে তাকে টার্গেট করা। এ আইন বাস্তবায়নে নাগরিক ও অন্য অংশীদারদের সঙ্গে নেয়া উচিত সরকারের।  

নির্বাচনী রেজ্যুলেশনে নিশ্চিত করতে হবে যে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সব রকম সুযোগ পাবেন নাগরিক পর্যবেক্ষকরা। আইনগত ও অহিংস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার সময়ে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের তরফে সহিংসতার মুখে পড়া উচিত হবে না। সব দলকে প্রকাশ্যে অহিংস থাকার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে এবং তাদের নিজেদের সদস্য বা সমর্থকদের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতার নিন্দা জানাতে হবে। নির্বাচনে অহিংসতা নিশ্চিত করতে বহুদলীয় আচরণবিধির সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত সব দলের। নির্বাচনে নারীর বিরুদ্ধে অনলাইন ও অফলাইনে সহিংসতা প্রতিরোধ, চিহ্নিত করা এবং সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্য অংশীদারদের পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা শক্তিশালী করতে হবে। তাদের স্টাফ বৃদ্ধি করে এবং তহবিল যোগান দিয়ে ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।

যেসকল রাজনৈতিক দলগুলো অহিংসতায় জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্যতা দেখায়, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রদর্শন করে এবং অবাধ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচারণা চালায় সেসকল দলগুলোকে নিবন্ধন দিতে হবে।

রাজনৈতিক নেতাকর্মী, নাগরিক সমাজের নেতা এবং মিডিয়ার প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে সব মুলতবি বিচারিক মামলার দ্রুত এবং বিশ্বাসযোগ্য বিচারিক রিভিউ করতে হবে।

নির্বাচন যাতে অহিংস হয় এমন পরিবেশ বজায় রাখতে সব অংশীদারকে অবদান রাখা উচিত।