কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান সিঙ্গাপুরের হোটেলে

কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান সিঙ্গাপুরের হোটেলে

আউটরাইডে একজন পুলিশ। আছেন একজন নিরাপত্তা প্রহরী। এর মধ্যদিয়ে ছুটে চলেছে একটি বিলাসবহুল লিমুজিন। সিঙ্গাপুরের ইস্টকোস্ট পার্কওয়ে থেকে ২০ মিনিটের ড্রাইভ। এ সময়ে ১৮ কিলোমিটার অতিক্রম করার পরেই একটি হোটেল। ওই হোটেলেই প্রথম কিছুটা নিশ্চিন্তে রাত যাপনের জন্য বুকিং করা ছিল শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের জন্য। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৭৩ বছর বয়সী শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর সাবেক এই লেফটেন্যান্ট কর্নেল পরে রাজনীতিকের এতটুকুই ছিল শেষ রাইড। প্রেসিডেন্সিয়াল রাইড। সেখান থেকেই তিনি পদত্যাগপত্র ই-মেইল করেন। ফলে ইস্টকোস্ট পার্ক থেকে ২০ মিনিটের ওই পথটুকুতেই তিনি প্রেসিডেন্টের মর্যাদা পেয়েছেন।

এরপরই তিনি একজন সাধারণ নাগরিক। তার ওই পদত্যাগপত্র দেশটির পার্লামেন্ট শুক্রবার গ্রহণ করেছে। যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন থেকে সংকট শুরুর পূর্ব পর্যন্ত সিংহলিজদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন ছিল তার প্রতি। কিন্তু এ বছর তিনি এবং রাজাপাকসে পরিবার দেশের মধ্যে চরম ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। এ জন্য পরিবারের একজন সদস্যও সম্মানের সঙ্গে মানুষের সামনে দাঁড়াতে পারেননি। যে জনগণ তাদেরকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিল তারা পর্যন্ত ঘৃণা প্রকাশ করেছে। এ জন্য পালাতে বাধ্য হন গোটাবাইয়া রাজাপাকসে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, প্রথমে তিনি বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাকে অনুমতি দেয়নি কেউ। কারণ তার হাতে নাগরিকদের রক্ত।

গৃহযুদ্ধ চলাকালে তিনি তামিলদের অকাতরে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং সেভাবেই তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। জনতার ধিক্কার এবং এই বিচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কোনোমতে পালিয়ে মালদ্বীপে আশ্রয় নিতে সক্ষম হন। কিন্তু সেখানেও জনরোষে পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে সেখান থেকে পালিয়ে যান সিঙ্গাপুর। ১৫ দিন তিনি সেখানে থাকতে পারেন। ওদিকে দেশের পার্লামেন্ট নতুন একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করেছে শনিবার। একই দিন জ্বালানিবাহী একটি চালান এসে পৌঁছেছে। এতে সংকটে আটকে থাকা এ দেশটির মানুষের কিছুটা স্বস্তি হতে পারে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এদিন পার্লামেন্টের আশপাশের সড়কগুলোতে কমপক্ষে ১০০ পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন করা হয। তাদের সঙ্গে ছিল অ্যাসল্ট রাইফেল। পার্লামেন্টমুখী অন্য একটি সড়কে টহল দিচ্ছিল নিরাপত্তারক্ষীরা। এদিন পার্লামেন্টের সেক্রেটারি জেনারেল ধাম্মিকা দেশানায়েকে আনুষ্ঠানিকভাবে গোটাবাইয়ার পদত্যাগপত্র পড়ে শোনান। এতে যা লেখা ছিল তা এরই মধ্যে প্রকাশ্যে আলোচনা হয়েছে। গোটাবাইয়া তার বাইরে বলেছেন, বছরে পর বছর ধরে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাই হলো দেশের অর্থনৈতিক সংকটের মূল।

এ সংকট তার প্রেসিডেন্সিরও অনেক আগে থেকে চলছে। বিশেষ করে করোনা মহামারি সংকটকে আরও করুণ অবস্থায় নিয়ে গেছে। এর ফলে নাটকীয়ভাবে শ্রীলঙ্কায় পর্যটকের সংখ্যা কমে গেছে। কমে গেছে বিদেশে নিজের দেশের শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স। তিনি আরও লিখেছেন, আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস হলো- এসব সংকট সমাধানে আমি সম্ভাব্য সব রকম পদক্ষেপ নিয়েছি। এর মধ্যে সর্বদলীয় বা জাতীয় সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানিয়েছি আমি। এখন প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র গ্রহণের জন্য মঙ্গলবার আবার বসবে পার্লামেন্ট। দেশে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য ভোট হবে বুধবার। অন্যদিকে ৬ বারের প্রধানমন্ত্রী ও রাজাপাকসে পরিবারের ঘনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী রণিল বিক্রমাসিংহে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হিসেবে তাকেই নির্বাচন করা হয়েছে শুক্রবার। যদি তিনি নির্বাচিত হন তাহলে আবার বিক্ষোভ হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই মানছিলেন না বিক্ষোভকারীরা।

গোটাবাইয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারও পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। তিনি যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তাহলে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি নাও হতে পারে। ওদিকে বিরোধীদলীয় প্রার্থী হচ্ছেন সাজিথ প্রেমাদাসা। তাবে ক্ষমতাসীন দলের এমপি ডুল্লাস আলাহাপেরুমা’ও ডার্কহর্স হয়ে উঠতে পারেন। শ্রীলঙ্কার সংকটময় পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে অব্যাহত সমর্থন দিতে নিশ্চয়তা দিয়েছে ভারত। শনিবার শ্রীলঙ্কার স্পিকার মাহিন্দ ইয়াপা আবিওয়ার্ডেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতীয় হাইকমিশনার গোপাল বাগলে। তিনিই এই নিশ্চয়তার কথা জানিয়ে এসেছেন। প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়ার পদত্যাগপত্র গ্রহণের একদিন পর এই মিটিং হলো তাদের মধ্যে গতকাল। ১৫ দিনের মধ্যে সিঙ্গাপুর ছাড়তে হবে গোটাবাইয়াকে, জানেন না কোথায় যাবেন: বর্তমানে সিঙ্গাপুরেই রয়েছেন গোটাবাইয়া রাজাপাকসে। দেশ থেকে পালিয়ে সিঙ্গাপুরে আশ্রয় নেন তিনি।

তবে রাজাপাকসের পরবর্তী গন্তব্য কি তা এখনো জানা যায়নি। সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম নিউজ১৮ জানিয়েছে, সিঙ্গাপুরও তাকে বেশিদিন আশ্রয় দিতে চায় না। তারা মাত্র ১৫ দিন থাকার অনুমতি দিয়েছে গোটাবাইয়াকে। এরপরই তাকে পাড়ি দিতে হবে নতুন কোনো আশ্রয়ে। ৭৩ বছর বয়স্ক রাজাপাকসে তার স্ত্রী এবং দুই নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে নিয়ে সামরিক জেটে করে শ্রীলঙ্কা থেকে পালান। তারা এখনো গোটাবাইয়ার সঙ্গে আছেন। প্রথমে মালদ্বীপ এবং পরে সৌদি এয়ারলাইন্সের বিমানে করে সিঙ্গাপুর আশ্রয় নেন গোটাবাইয়া। সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ তাকে ১৫ দিন আশ্রয়ের সুযোগ দিয়েছে এবং এই সময়কাল বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা নেই। সূত্র আরও জানিয়েছে, রাজাপাকসে এখনো তার পরবর্তী গন্তব্য ঠিক করতে পারেননি। ১৫ দিনের সময় শেষ হয়ে গেলে তিনি কোথায় যাবেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। আরেক সূত্রের বরাত দিয়ে নিউজ১৮ জানিয়েছে, রাজাপাকসে ভারতে আশ্রয় চেয়েছিলেন। তবে ভারত সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারত চায় না শ্রীলঙ্কার জনগণ তাদেরকে নিজেদের শত্রু ভাবুক।-মানবজমিন