কাস্টমস সার্ভারে হ্যাকার জহিরুলের কারসাজি

কাস্টমস সার্ভারে হ্যাকার জহিরুলের কারসাজি

চট্টগ্রাম বন্দরসহ দেশের ৪ বন্দরে জব্দ প্রায় ১২ হাজার (১১ হাজার ৯১৬টি) পণ্যভর্তি কনটেইনার গায়েব করা হয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর, চট্টগ্রাম কাস্টমস) সার্ভার হ্যাক করে। এ হ্যাকিংয়ের মূল হোতা স্বনামধন্য একটি গ্রুপ অব কোম্পানির কম্পিউটার অপারেটর জহিরুল ইসলাম। তিনি অনেক দিন ধরেই টাকার বিনিময়ে হ্যাকিং করে আসছেন।

তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে রবিবার সকালে তাকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হ্যাকার জহিরুল এনবিআরের সার্ভার হ্যাক করে কীভাবে শত শত কোটি টাকার পণ্যভর্তি কনটেইনার পাচার করেছেন, তার চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। জানিয়েছেন, সংঘবদ্ধ হ্যাকার চক্রটি তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিল অব এন্ট্রির ইউজার আইডি ও গোপন পাসওয়ার্ডের লক ভেঙে শত শত কোটি টাকার পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছাড় করে নিয়ে গেছে। চক্রটি ২০১৬ সাল থেকে এনবিআরের সার্ভারে লগইন করেছে ৩ হাজার ৭৭৭ বার। এ ছাড়া এনবিআরের চিঠিও জাল করেছে চক্রটি। জহিরুল তার ব্যবহৃত কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমেও এনবিআরের

সার্ভার হ্যাক করতেন। এই হ্যাকার চক্রকে সহযোগিতা করেছেন চট্টগ্রাম কাস্টমস, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী।

গত ১৭ জানুয়ারি ‘পণ্যভর্তি ১২ হাজার কনটেইনার গায়েব’ শিরোনামে একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন ছাপা হয় আমাদের সময়ে। এর পরই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। কনটেইনার গায়েবের ঘটনায় রাজধানীর রমনা থানায় একটি মামলা করা হয় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের তরফে। মামলায় বাদী হন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন। জালিয়াতির অভিযোগে তিনটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো পুরান ঢাকার গুলশান আরা সিটি মার্কেটের জারা এন্টারপ্রাইজ; ৪/১ হেয়ার স্ট্রিট, ওয়ারীর মেসার্স চাকলাদার সার্ভিস এবং এমআর ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। এর পর গ্রেপ্তার করা হয় এমআর ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক মিজানুর রহমান চাকলাদারকে। মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

এদিকে গতকাল জহিরুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের পর শুল্ক ফাঁকি, প্রতারণা, জালিয়াতি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ কয়েকটি ধারায় রমনা থানাতেই আরও ২০টি মামলা করার প্রস্তুতি নিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। মামলায় অভিযুক্ত করা হচ্ছে ৬৭ জনকে। গত রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মামলা করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন ছিল।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের ৪ বন্দরে জব্দকৃত ১১ হাজার ৯১৬টি পণ্যভর্তি কনটেইনারের মধ্যে বেশিরভাগই হয়েছে চট্টগ্রাম সামুদ্রিক বন্দর থেকে। এর মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কম্পিউটারে সংরক্ষিত বিল অব এন্ট্রির গোপন পাসওয়ার্ডের লক ভেঙে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ২ হাজার ৬২৭টি, কমলাপুর আইসিডি থেকে ২২৩টি এবং মোংলা বন্দর থেকে ১০টি কনটেইনার গায়েব করা হয়। একইভাবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ২ হাজার ১৬২টি, কমলাপুর আইসিডি থেকে ৭৪টি, পানগাঁও বন্দর থেকে ২টি এবং মোংলা বন্দর থেকে ১৪টি কনটেইনার গায়েব করা হয়। অন্যদিকে গত বছর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৬ হাজার ৭১১টি, কমলাপুর আইসিডি থেকে ৩৪টি, মোংলা বন্দর থেকে ২৯টি এবং পানগাঁও বন্দর থেকে ৩০টি জব্দকৃত কনটেইনার গায়েব করা হয়। মিথ্যা ঘোষণায় বিদেশ থেকে পণ্য আনার বিষয়টি শুল্ক কর্তৃপক্ষের গোচরে এলে ১১ হাজার ৯১৬টি কনটেইনার শুল্কায়নের মাধ্যমে ছাড়করণ স্থগিত করে শুল্ক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু অসাধু চক্র বিল অব এন্ট্রির ইউজার আইডির গোপন পাসওয়ার্ডের লক ভেঙে এ বিপুল পরিমাণ কনটেইনার বন্দর থেকে নিয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের রাজস্ব দেওয়া হয়নি। ফলে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে শত শত কোটি টাকার। আর ভয়ঙ্কর এ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে সংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে। এর সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। হ্যাকার জহিরুল ইসলাম ছিলেন আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের কমিশন এজেন্ট।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. সহিদুল ইসলাম বলেন, জাল জালিয়াতির মাধ্যমে দেশের ৪ বন্দরে জব্দ করা পণ্যভর্তি কনটেইনার গায়েব করার ঘটনায় এনবিআরের সার্ভার হ্যাকিংয়ের সঙ্গে জড়িত মো. জহিরুল ইসলাম নামে এক কম্পিউটার অপারেটরকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাকে ঢাকায় আনা হচ্ছে। ঘটনা অনুসন্ধানে চমকপ্রদ ও উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া গেছে। এ জালিয়াতির ঘটনায় রাজধানীর রমনা থানায় ৬৭ জনকে অভিযুক্ত করে আরও ২০টি মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের ডিসি মো. সাজ্জাদুর রহমান জানিয়েছেন, ৪ বন্দরে জব্দ করা পণ্যভর্তি কনটেইনার গায়েবের ঘটনায় মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।