কোস্টাল রেডিও স্থাপন

৫০ লাখ টাকার স্পিড বোট ১০ কোটি টাকা

৫০ লাখ টাকার স্পিড বোট ১০ কোটি টাকা

উন্নয়ন প্রকল্প ব্যয়ে কোনো ধরনের লাগাম নেই। অনুমোদন পাওয়ার পর ব্যয় বাড়ছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে থাকছে তো না-ই, উল্টো তিন বছরের প্রকল্প চলছে ছয় বছর ধরে। প্রকল্পপণ্যের দর নিয়েও অনেক প্রশ্ন পরিকল্পনা কমিশনের। কখনো যাচাই করা হয় না। আবার অনুমোদন নিয়ে পরে সংশোধনীতে মাত্রাতিরিক্ত দর ধরা হয়। যেখানে তিনটি ক্যাবিন পেট্রল বোটের দর ধরা হয় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, সেখানে দ্বিতীয় সংশোধনীতে এসে একটির দাম ধরা হয় ১০ কোটি টাকা। আর প্রকল্পটি হলো দেশের উপকূলীয় এলাকায় সাতটি লাইট হাউজ ও কোস্টাল রেডিও স্থাপন। ৩৭০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রকল্প খরচ এখন ১০৪.৪৫ শতাংশ বা ৩৮৭.৪০ কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭৫৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা। বিনোদন খাতে ব্যয় এবং ক্যাবিন টাইপ হাই স্পিডবোট ক্রয়ে অস্বাভাবিক দাম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ। তারা বলছেন, ক্রয় আদেশ দেয়ার পর এ ধরনের ব্যয় বৃদ্ধির সুযোগ নেই। নির্মাণব্যয় বৃদ্ধি বিবেচনায় নেয়া না হলে সিডি-ভ্যাট বাবদ ৭২ কোটি টাকা বৃদ্ধির বিষয়টিও থাকবে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এস্ট্যাবলিসমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেইফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম প্রকল্পটি দ্বিতীয় দফায় আবারো ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। ৩৭০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৪ সালের ১১ মার্চ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়। কথা ছিল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত করা হবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি না থাকায় ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ আড়াই বছর বৃদ্ধি করা হয়। তাতেও প্রকল্পের কাজে গতি নেই। আরো ৩০২ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্পটি দ্বিতীয় সংশোধনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সেই সাথে মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়ানোর জন্য বলা হয়েছে।

ব্যয় পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, তিনটি ক্যাবিন টাইপ পেট্রল স্পিডবোট কেনার জন্য মূল প্রস্তাবনায় ছিল দেড় কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি বোটের দাম ৫০ লাখ টাকা করে ধরা হয়। প্রথম সংশোধনীতে একই ব্যয় বরাদ্দ ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় সংশোধনীতে এসে এই বোটের দাম প্রতিটি ১০ কোটি টাকা ধরে তিনটির দাম ৩০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। দুবলার চর, চর কুকরি মুকরি, সেন্টমার্টিন প্রকল্প এলাকা হিসেবে আগেও ছিল। অথচ পূর্বে কোনো ধরনের হাই স্পিড ও হাই পারফরম্যান্স বোটের প্রয়োজন হয়নি। প্রকল্পের শেষ সময়ে এসে এতো টাকায় বোট কেনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ।

প্রকল্পে পরামর্শক সেবার জন্য ব্যয় ধরা হয় ১৫ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এক লাফে এই ব্যয় প্রায় ১১ কোটি টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। বৈদেশিক প্রশিক্ষণ নেয়ার কথা ছিল ২৫ জনের। এই খাতে ব্যয় ১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। কিন্তু সরকারি খাত থেকে কোনো বরাদ্দ এই খাতের জন্য ছিল না। বর্তমানে সংশোধনীতে এই খাতে ব্যয় বাড়তি ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। ফলে এই খাতে ব্যয় ২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা করা হলো। প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে এই ধরনের ব্যয় বৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয় বলে ভৌত অবকাঠামো বিভাগ বলছে। তেমনিভাবে মাটির কাজে ব্যয় ২৯ কোটি টাকা বাড়ানোয় আপত্তিও জানানো হয়েছে।

গত জুন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে অর্থ ব্যয় হয়েছে ১১৫ কোটি ৩২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। আর বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ১৫.২১ শতাংশ। পরামর্শক খাতে ব্যয় হয়েছে ১১ কোটি ৮৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা গেছে। এই প্রকল্পে কোরিয়া আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো, টার্ন-কি পদ্ধতিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় সাতটি লাইট হাউজ ও কোস্টাল রেডিও স্টেশন স্থাপন, ঢাকায় একটি কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে জাহাজের সাথে ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাসহ নৌনিরাপত্তা, সিকিউরিটি ও সার্ভিল্যান্স প্রতিষ্ঠা করা। নৌসহায়ক যন্ত্রপাতি স্থাপন ও পরিচালনা, আন্তর্জাতিক কনভেনশনের চাহিদা পূরণ। বর্তমান লাইট হাউজ আধুনিকীকরণ ও নতুন লাইট হাউজ স্থাপন, অনুসন্ধান ও উদ্ধারকার্যক্রমের সমন্বয় সাধন করা। বর্তমানে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড দ্বারা পরিচালিত মংলা এবং ছিলিমপুর রেডিও স্টেশনে জিএমডিএসএসের যন্ত্রপাতি বা জনবল নেই। সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার ও কুতুবদিয়াতে তিনটি লাইট হাউজ (বাতিঘর) রয়েছে। যা অনেক পুরনো। মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ না পাওয়ার কারণে লাইট হাউজগুলো যথার্থ কার্যকর নয়। তা ছাড়া কুয়াকাটা, নিঝুম দ্বীপ, ঢালচর এবং দুবলার চরে আরো চারটি লাইট হাউজ স্থাপন করা প্রয়োজন। এসব সংশ্লিষ্ট স্থলভিত্তিক অবকাঠামোও নির্মাণ করা প্রয়োজন।

ভৌত অবকাঠামো বিভাগ যুগ্ম প্রধান স্বাক্ষরিত কার্যপত্রে তিনি বলছেন, মূল প্রকল্প থেকে প্রকল্পের ব্যয়ে বৈদেশিক সাহায্য বেড়েছে মাত্র ৯ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। আর সরকারি খাতে বেড়েছে ৩৭৮ কোটি টাকা, যা বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের উদ্দেশ্য ব্যাহত করেছে বলে কমিশন মনে করছে।

এমজে/