ঢাকায় বেপরোয়া সালাম, টানা ও গামছা পার্টি

ছিনতাই চক্র লুটে নিচ্ছে সর্বস্ব, কাড়ছে প্রাণ

ছিনতাই চক্র লুটে নিচ্ছে সর্বস্ব, কাড়ছে প্রাণ

রাজধানী ঢাকায় ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ছিনতাই চক্র। গামছা পার্টি, সালাম পার্টি, টানা পার্টিসহ নানা বাহারি নামে সক্রিয় এসব অপরাধী। এরা নানা কৌশলে লুটে নেয় সর্বস্ব। বেশি শিকার হন রিকশা ও অটোরিকশার যাত্রী। প্রতিবাদ করলেই এদের হাতে খোয়াতে হয় প্রাণ। দিনে তৎপর থাকে সালাম পার্টি। আর রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে টানা পার্টি ও গামছা পার্টির তৎপরতা। এদিকে ৩ দিনে নগরীতে র‌্যাব-পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে অর্ধশতাধিক ছিনতাইকারী।

মুগদায় ২৯ ফেব্রুয়ারি ভোরে টানা পার্টির কবলে পড়ে প্রাণ খুইয়েছেন সিলেটের গৃহবধূ তারিনা বেগম লিপি। স্বামী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় আত্মীয়ের বাসায় বেড়ানো শেষে ফেরার পথে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের সামনে পৌঁছাতেই প্রাইভেট কারে আসা টানা পার্টি তারিনার ব্যাগ ধরে টান দেয়। এতে তিনি রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান। এ ঘটনায় মামলা হলেও এখন পর্যন্ত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ।

জানুয়ারিতে উত্তরার ৫নং সেক্টরের ৩নং সড়কে এক স্কুলশিক্ষিকার ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়ার ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, ওই শিক্ষিকা রিকশায় যাওয়ার সময় মোটরসাইকেলে এসে দুই ছিনতাইকারী ছুরি ঠেকিয়ে তার ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় ফিরে এসে তার শরীর তল্লাশি করে স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেয়।

এর আগে ১৩ জানুয়ারি চানখাঁরপুলে শামীম নামে এক ব্যক্তি সালাম পার্টির খপ্পরে পড়ে ৫০ হাজার টাকা খোয়ান। নিউমার্কেট থেকে রিকশায় গুলিস্তানে যাওয়ার সময় আনন্দবাজার এলাকায় একজন তাকে সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে। এমন সময় পাশ থেকে দু’জন এসে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার অর্থকড়ি হাতিয়ে নিয়ে যায়। পরদিন বকশীবাজারের নবকুমার ইন্সটিটিউটের সামনে সালাম পার্টির শিকারে পরিণত হন অনিমেষ কান্তি হালদার নামে এক সরকারি কর্মকর্তা। একই কৌশলে দুর্বৃত্তরা তার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোন নিয়ে যায়।

গামছা পার্টির সদস্যরা রাত ৮টা থেকে ভোর পর্যন্ত সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায়। এ চক্রের এক সদস্য অটোরিকশা চালায়। আর দু’জন পেছনে বসা থাকে। টার্গেট ব্যক্তিকে কৌশলে সিএনজিতে তোলে। এরপর দু’জনের মাঝখানে বসিয়ে কেড়ে নেয় সর্বস্ব। প্রতিবাদ ও নড়াচড়া করলে গলায় গামছা পেঁছিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে। পরে লাশ নির্জন স্থানে ফেলে দেয়।

সম্প্রতি তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ একটি হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে গামছা পার্টির ৪ সদস্যকে গ্রেফতার করে। ১০ ডিসেম্বর থেকে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮ জনকে হত্যার কথা স্বীকার করে তারা। আবার অজ্ঞান বা অর্ধমৃত অবস্থায় ৩০-৪০ যাত্রীকে বিভিন্ন ফ্লাইওভার বা নির্জন স্থানে ফেলে দেয়ার কথাও স্বীকার করে চক্রের সদস্যরা- এসব যাত্রীর অনেকেই বাস-ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছেন। এরা প্রতি রাতে ১ থেকে ৬টি ছিনতাই করত বলেও পুলিশের কাছে স্বীকার করে।

অনিমেষ কান্তির খোয়া যাওয়া মোবাইল সেটটি নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্ধার করে ডিবি। গোয়েন্দা দক্ষিণ বিভাগের লালবাগ জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মো. সাইফুর রহমান আজাদ জানান, তারা (সালাম পার্টি) ছিনতাই করা মোবাইল অনলাইনে বিক্রি করে। এরা পুলিশকে জানিয়েছে- শাহবাগ, বংশাল, চকবাজার, পল্টন ও ওয়ারী, নিউমার্কেট, পলাশী, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল, চানখাঁরপুল হয়ে আনন্দবাজার সড়কে তাদের তৎপরতা বেশি।

পুলিশ জানায়, দিনে সক্রিয় থাকে সালাম পার্টি। রাত ৮টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত গামছা পার্টি এবং মধ্যরাত থেকে সকালে সড়কে লোকজনের আনাগোনা না হওয়া পর্যন্ত সক্রিয় থাকে টানা পার্টি। মধ্যরাত কিংবা ভোরে কর্মস্থল বা ঢাকার বাইরে থেকে এসে ঘরে ফেরা মানুষ বেশি ছিনতাইয়ের শিকার হন টানা ও গামছা পার্টির।

পুলিশ আরও জানায়, গত ৫ বছরে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় এ সংক্রান্ত মামলা হয়েছে প্রায় ১ হাজার। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছিনতাইয়ের শিকার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ব্যক্তিই পুলিশের কাছে যান না। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী- পুরান ঢাকা, মিরপুর, মতিঝিল, গাবতলী ও মোহাম্মদপুর এলাকায় ছিনতাই বেশি ঘটে। এছাড়া সাতরাস্তা, নাবিস্কো, মহাখালী বাস টার্মিনাল, মহাখালী রেলক্রসিং, বনানী, গুলশান-১, গুলশান লিংক রোড, রামপুরা ব্রিজ, ধানমণ্ডি, বংশাল, চকবাজার, কলাবাগান, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় গলিপথগুলোতে ওতপেতে থাকে ছিনতাইকারীরা। এসব পথে যাতায়াতকারী রিকশা বা হাঁটা যাত্রীদের ঠেক দিয়ে এরা ছিনিয়ে নেয় সর্বস্ব।

ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি বিজয় বিপ্লব তালুকদার বলেন, এ ধরনের ছিনতাইয়ের কবল থেকে রক্ষা পেতে হলে সাবধানে চলাফেরা করতে হবে। রিকশা-অটোরিকশায় অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে শেয়ারিংয়ে ওঠা যাবে না।

গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন বলেন, ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আমরা সে প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছি। অন্ধকারাচ্ছন্ন বা নীরব এলাকায় বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে জানিয়ে এসব রাস্তা দিয়ে নগরবাসীকে চলাচলের সময় সতর্ক থাকতে হবে। শনিবার এক ব্রিফিংয়ে তিনি নগরবাসীর উদ্দেশে বলেন, আপনারা থানায় যাবেন, অভিযোগ দেবেন। থানা যদি মামলা বা অভিযোগ নিতে অপারগতা প্রকাশ করে আমাদের ঊর্ধ্বতনদের জানাবেন। তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেছেন, টানা পার্টির সদস্যদের অধিকাংশই ভাসমান। এদের ৯৮ ভাগ মাদকাসক্ত। নেশার টাকার জোগাড়ে এরা ছিনতাইয়ে নামে। দিনের চেয়ে রাতে এদের তৎপরতা বাড়ে। কেউ এদের খপ্পরে পড়লে অন্তত থানায় গিয়ে মামলা কিংবা জিডি করার পরামর্শ দেন তিনি।

এমজে/