পাপুল সস্ত্রীক এমপি হন যেভাবে

পাপুল সস্ত্রীক এমপি হন যেভাবে

কুয়েত পুলিশের হাতে আটক লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর) আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল দেশ জুড়ে প্রথম আলোচনায় আসেন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে। ঐ আসনের দশম সংসদের সদস্য ও জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতা মোহাম্মদ নোমানের হঠাৎ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা এবং নোমানের ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের রহস্যজনকভাবে অবস্থান বদলে ‘আপেল’ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী পাপুলকে সমর্থন জানানোর ঘটনা তখন বহু আলোচনার জন্ম দেয়। পাপুল এমপি হওয়ার কিছুদিনের মাথায় তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামেরও সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য হওয়ার ঘটনা লক্ষ্মীপুরের সীমানা ছাড়িয়ে প্রায় দেশ জুড়ে আলোচিত হয়।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে দলের তখনকার এমপি মোহাম্মদ নোমানকে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে ‘লাঙ্গল’ প্রতীক বরাদ্দ দেয় জাপা। কার্যত নোমান ছিলেন মহাজোটের প্রার্থী। ১৯ ডিসেম্বর হঠাত্ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বিজ্ঞপ্তি’ দিয়ে ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। তখনই এলাকার সাধারণ ভোটার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতারা এ বিষয়ে মন্তব্য করেন, ‘এখানে টাকার খেলা হয়েছে।’ পাপুলের কাছ থেকে নোমান ‘টাকা নিয়েছেন’—এমনটাই তখন ছিল সবার মুখে মুখে। এমনকি কারো কারো মন্তব্য ছিল, ‘১২ কোটি টাকার খেলা’। এ নিয়ে তখন গণমাধ্যমেও একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যদিও ‘টাকার খেলা’ হওয়ার বিষয়টি তখন অস্বীকার করেছিলেন নোমান ও পাপুল দুজনই।

১৯ ডিসেম্বর নোমানের সরে দাঁড়ানোর ঘোষণার আগ পর্যন্ত রায়পুরে নির্বাচনের মাঠের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। মহাজোটের প্রার্থী এবং এই আসনের তখনকার এমপি হিসেবে নোমানের প্রচারণায় যুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রায় সবাই। নোমানের সরে যাওয়ার ঘোষণার পরপরই দ্রুত পালটে যায় সবকিছু। স্থানীয় পুরো আওয়ামী লীগ চলে যায় স্বতন্ত্র প্রার্থী পাপুলের পেছনে। প্রচারণার মাঠও রাতারাতি চলে যায় পাপুলের একচেটিয়া দখলে।

তখনকার এমপি নোমান কেন নির্বাচন থেকে সরে গেলেন, সেটিই ছিল তখন রায়পুরের মানুষের প্রধান আলোচনার বিষয়। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বিজ্ঞপ্তিতে নোমান নিজ দল জাপার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, লক্ষ্য নির্ধারণে অনিশ্চয়তা, কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয় ও সিদ্ধান্তহীনতার কথা উল্লেখ করেন। সরে যাওয়ার বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা চেয়ে নোমানকে নোটিশও দেয় জাপা। ব্যাখ্যায়ও নোমান একই কারণ উল্লেখ এবং টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন।

রায়পুর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে শহিদ ইসলাম পাপুলের আবির্ভাব ঘটে ২০১৬ সালের শেষ দিকে। তিনি কুয়েত শাখা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন। মারাফি গ্রুপ অব কোম্পানিজ নামে কুয়েতভিত্তিক একটি ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। এলাকায় এসেই তিনি আর্থিক অনুদান দেওয়া শুরু করেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশও তার পেছনে এসে জোটে। তবে দলের বড়ো অংশ ছিল তার বিপক্ষে। একাদশ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েও পাননি। পরে ‘আপেল’ প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।

বিপুল অর্থের বিনিময়ে নোমানের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৮ সালের নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে, ২২ ডিসেম্বর। ঐ দিন শহরের তাজমহল সিনেমা হলের সামনে দলের জরুরি সভায় আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি গোলাম ফারুক প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নোমান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।...অনেক টাকা, অনেক টাকা।’ তার ঐ বক্তব্য নিয়ে সেদিনের সভায় নেতাদের মধ্যে বিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। তখনকার জাপা দলীয় এমপি নোমানের ব্যক্তিগত সহকারী শাহ আলম নিজেও তখন গণমাধ্যমের কাছে বলেছিলেন, ‘পাপুলের কাছ থেকে ১২ কোটি টাকা নিয়ে তিনি (নোমান) সরে দাঁড়িয়েছেন বলে আমরা শুনেছি। তবে ওনাকে (নোমানকে) কয়েক দিন ধরে ফোনেও আমরা পাচ্ছি না।’

আর পাপুল তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘গত আড়াই বছরে আমি এলাকায় বিপুল কাজ করেছি। প্রায় ৩২ কোটি টাকা মানবসেবায় খরচ করেছি।’ নোমানের সঙ্গে টাকার লেনদেনের বিষয়ে পাপুল তখন বলেছিলেন, ‘উনি ফাইন্যান্সিয়ালি (আর্থিকভাবে) দুর্বল। নির্বাচনে থাকলে বড়োজোর ৫ হাজার ভোট পেতেন। এসব বুঝেই উনি সরে দাঁড়ান। এখানে লেনদেনের ঘটনা ঘটেনি।’

পরে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নির্বিঘ্নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যান পাপুল। নিজে এমপি হয়েই থামেননি তিনি। নতুন মিশন নেন স্ত্রী সেলিনাকেও এমপি করার। সংরক্ষিত আসনে কোটা পূর্ণ করতে একাধিক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যসহ কয়েক জনের সঙ্গে সমঝোতায় যান পাপুল। মিশনে সফল হয়ে স্ত্রীকেও চলতি সংসদের সদস্য করেন।সূত্র : ইত্তেফাক

এমজে/