সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে বিদেশ থেকে তহবিল সংগ্রহের পথ

সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে বিদেশ থেকে তহবিল সংগ্রহের পথ

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নেয়ার নীতিমালায় বিশেষ ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে ব্যাংকগুলো অফশোর ব্যাংকিংয়ের (ওবিইউ) মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় তহবিল সংগ্রহ করলে বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার (সিআরআর) প্রচলিত অবস্থা থেকে অর্ধেক সংরক্ষণ করতে হবে। অর্থাৎ ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে, যা দৈনিক ভিত্তিতে করতে হবে দেড় শতাংশ। আর ব্যাংকগুলোর নিজস্ব তহবিল থেকে ওবিইউতে বিনিয়োগসীমা বৃদ্ধি করে ২০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিদেশ থেকে তহবিল সংগ্রহের পথ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ বিশেষ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

সিআরআর সংরক্ষণ হারে এ বিশেষ ছাড় দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৭২ এর ৩৬(১) এর ক্ষমতাবলে গতকাল এক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনটিতে স্বাক্ষর করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল।

জানা গেছে, স্থানীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে সুদহার বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীদের বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশ থেকে ঋণ নেয়ার জন্য ২০১৩ সালে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পাওয়ার পর ব্যবসায়ীরা বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশ থেকে ঋণ নিতে উৎসাহী হয়ে পড়েন। ব্যাংকগুলোও সমান তালে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করতে থাকে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় প্রকৃতপক্ষে বেশি ব্যয়ের এ বিদেশী ঋণ অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। বিদেশী এ ঋণের মাধ্যমে অর্থপাচারের ঘটনাও ধরা পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে। বৈদেশিক মুদ্রায় দায় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় নড়েচড়ে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক। অবশেষে গত বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি অফশোর ব্যাংকিং নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহিত করতে ওই নীতিমালায় বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিতে কিছু শর্তারোপ করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বৈদেশিক মুদ্রায় যত তহবিল আহরণ করা হবে তার ওপর স্থানীয় তহবিলের মতো নির্ধারিত হারে বাধ্যতামূলক তরল সম্পদ সংরক্ষণ তথা এসএলআর ও বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার অর্থাৎ সিআআর সংরক্ষণ করতে হবে।

জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট হলো ব্যাংকগুলো বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় তহবিল সংরক্ষণ করে। আবার সেই তহবিল স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ বিদেশী কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত নিয়ে তা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ওপর ঋণ সৃষ্টি করে আবার ওই অর্থ বিদেশী অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকেই পরিশোধ করা হয়। এতে শুধু পণ্য দেশে আসে। বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে না। আবার বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় সুদাসলে পরিশোধ করতে হয়। মাঝখানে স্থানীয় ব্যাংকগুলো সংযোগকারী হিসেবে কিছু কমিশন পেয়ে থাকে।

এই ঋণে আপাতত সুদহার কম হলেও প্রকৃতপক্ষে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করায় বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের কারণে মেয়াদ শেষে প্রকৃতপক্ষে বেশি পড়ে যায়। যেমন, প্রতি ডলার ৭৭ টাকা মূল্যে ঋণ গ্রহণ করা হয়। দুই বছর বা তিন বছর পর যখন পরিশোধ করা হবে তখন ডলারের দাম বেড়ে ৮৭ টাকা হলো। এতে প্রকৃত মুনাফা অনেক বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ওবিইউতে বৈদেশিক মুদ্রায় দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৭ টাকা হিসাবে)। এ বিদেশী তহবিলের সুদ হিসেবে প্রতি বছরই বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। এ বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রায় দায় সৃষ্টি হওয়ায় গত বছর এটা নিরুৎসাহিত করতে গাইডলাইন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের কারণে প্রতিটি দেশেরই অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। ফলে ওবিইউয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ আসার পরিমাণ প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ দিকে, প্রতি মাসেই ওবিইউয়ের মাধ্যমে যে ঋণ নেয়া হয়েছিল তার কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা আগমনের চেয়ে বহির্গমনের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এমনি পরিস্থিতি ওবিইউয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণপ্রবাহ অব্যাহত রাখতে নীতিমালায় বিশেষ ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে ওবিইউয়ের মাধ্যমে আহরণকৃত তলবি ও মেয়াদি তহবিলের ওপর প্রচলিত পদ্ধতিতে সিআরআর সংরক্ষণ না করে দৈনিক ভিত্তিতে দেড় শতাংশ এবং দুই সপ্তাহ অন্তর ২ শতাংশ সংরক্ষণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে সিআরআর হার রয়েছে দৈনিক ভিত্তিতে সাড়ে তিন শতাংশ এবং দুই সপ্তাহ অন্তর ৪ শতাংশ। অপর দিকে ওবিইউয়ের মাধ্যমে বিদেশ থেকে তহবিল সংগ্রহের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর নিজস্ব তহবিল থেকে ওবিইউতে বিনিয়োগসীমা বাড়ানো হয়েছে। আগে ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ওবিইউতে ২০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারত। এখন তা বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে বেশি মাত্রায় ওবিইউতে বিনিয়োগ করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, বেশি হারে বিনিয়োগের সুযোগ দেয়ায় যেসব ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রায় বাড়তি তহবিল রয়েছে ওইসব ব্যাংক বেশি হারে বিনিয়োগ করতে পারবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রায় দেশের মুনাফা দেশেই থেকে যাবে।

এমজে/