২০ কোটি টাকায় পদোন্নতি পেয়েছে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম

২০ কোটি টাকায় পদোন্নতি পেয়েছে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম

ঘুষ নিয়ে এবং ‘ঘনিষ্ঠ’ ঠিকাদারদের কাজ দেওয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করার অভিযোগ আগেই উঠেছে গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) মো. আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে। অভিযোগ আছে, নামে-বেনামে দেশেই সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশেও পাচার করেছেন।

নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও জমা পড়েছে অভিযোগ। সবশেষ সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) আশরাফুল আলমের সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এবার অভিযোগে জানা গেছে, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদ থেকে প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পেতে ‘পরামর্শক’কে দেওয়ার জন্য ২০ কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে আশরাফুল আলমকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রীতিমতো স্ট্যাম্পে সই করে চেকের মাধ্যমে এই টাকা লেনদেন হয়। তবে তাতেও কাজ হয়নি। চুক্তির বাইরেও খরচ করতে হয়েছে আরো ১০ কোটি টাকা। বাড়তি এই অর্থ লেনদেন হয়েছে নগদ টাকায়। অর্থাৎ অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী থেকে প্রধান প্রকৌশলী হতে গণপূর্তের ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলামকে একজনের কাছে ২০ কোটি টাকা ও বিভিন্ন জায়গায় আরো ১০ কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আশরাফুল ইসলামের দিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে যে চুক্তিনামা ও চেকের মাধ্যমে ২০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে, সেই চুক্তিনামা ও চেকের কপি সংরক্ষিত রয়েছে গণমাধ্যমের কাছে।

১৫তম ব্যাচের প্রকৌশলী আশরাফুল আলমের গ্রামের বাড়ি বগুড়ায়। সবশেষ তিনি গণপূর্ত অধিদফতরের রংপুর জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদে ছিলেন। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পান।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রংপুর জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী থাকা অবস্থাতেই ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পেতে একজনকে ‘পরামর্শক ফি’ বাবদ ২০ কোটি টাকা দেওয়ার বিষয়ে একটি চুক্তি হয়। চুক্তিতে আশরাফুল আলমের পক্ষে তার শ্যালক সদরুল ইসলাম সায়মন এবং পরামর্শকের পক্ষে ঠিকাদার রিন্টু আনোয়ার সই করেন। চুক্তিনামায় ১১৪/৪ পশ্চিম আগারগাঁও, ১৬৪ উত্তর বাড্ডা ও ২৮ পূর্ব নয়া টোলা ঠিকানার তিন ব্যক্তির সইও আছে সাক্ষী হিসেবে।

চুক্তিনামায় আশরাফুলের শ্যালকের বয়ানে বলা হয়, আমার আত্মীয় (দুলাভাই) মো. আশরাফুল আলমের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতিতে সহযোগিতা করার জন্য রিন্টু আনোয়ারের সঙ্গে পরামর্শক হিসেবে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে চুক্তিবদ্ধ হলাম। পরামর্শক হিসেবে পারিশ্রমিকের বিনিময় ২০ কোটি টাকা নির্ধারিত হলো।

আশরাফুল ইসলামের শ্যালক সদরুল ইসলাম সায়মনের সই করা ওই চুক্তিনামায় আরো বলা হয়, আমি আশরাফুল আলমের সম্মতি, অনুরোধ ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রিন্টু আনোয়ারের অফিসে (৩৪, বিজয় নগর, চতুর্থ তলা) উপস্থিত হয়ে আমার নামের অ্যাকাউন্টের ২০ কোটি টাকার তারিখবিহীন একটি চেক অগ্রিম হিসেবে সাক্ষীদের উপস্থিতিতে নিজ হাতে সই করে হস্তান্তর করলাম। প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে আশরাফুল আলমের পদোন্নতির চিঠি পাওয়ার সাত কার্যদিবসের মধ্যে রিন্টু আনোয়ার এই চেক নগদায়ন করে নিতে পারবেন। এই সময়ের মধ্যে আমি চেকটি নগদায়ন করে না দিলে রিন্টু আনোয়ার চেকটি ডিজঅনার করে আমার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

যে চুক্তিনামায় আশরাফুলের পদোন্নতি সংক্রান্ত ২০ কোটি টাকার লেনদেনের ‘সুরক্ষা’ দেওয়া হয়, সেই চুক্তিনামার কপি গণমাধ্যমের কাছে রয়েছে। এছাড়া রূপালী ব্যাংকের রাজশাহী, লক্ষ্মীপুর শাখার ওই চেকের একটি কপিও রয়েছে গণমাধ্যমের কাছে। চুক্তিনামা ও ব্যাংক চেক পর্যালোচনা করে উভয় নথিতে সদরুল ইসলাম সায়মনের সই একই বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

১০ নভেম্বরের ওই চুক্তির পর ৩১ ডিসেম্বর গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পদোন্নতি পান আশরাফুল আলম। তবে অভিযোগ ওঠে, এরপর চুক্তির ওই ২০ কোটি টাকা পরিশোধ করেননি তার শ্যালক সায়মন।

গণপূর্তের একাধিক সূত্র জানায়, ওই টাকা তুলতে গত ২১ জুলাই রিন্টু আনোয়ার তার দলবলসহ প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলমের কক্ষে যান। এসময় কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনাও ঘটে। গণপূর্তের একাধিক কর্মকর্তা ও ঠিকাদার গণমাধ্যমের কাছে এই কথা কাটাকাটি ও মারামারির ঘটনা স্বীকার করেছেন।

২০ কোটি টাকার চুক্তির বিষয়ে জানতে গণমাধ্যম থেকে ঠিকাদার রিন্টু আনোয়ারের বিজয়নগরের অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে ঘনিষ্ঠ একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এসব বিষয়ে আপনারা (সাংবাদিকরা) সবই জানেন। নতুন করে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।’ তিনি আশরাফুল আলম ও তার শ্যালক সায়মনের কাছ থেকে এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে বলেন।

চুক্তিনামায় আশরাফুল আলমের শ্যালক সায়মনের বাসার যে ঠিকানা রয়েছে, ধানমন্ডির সেই বাসায় গিয়ে দেখা পাওয়া যায় তার। চুক্তিনামার বিষয়টি বারবারই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি দাবি করেন, চুক্তিনামায় দেওয়া সেই তার নয়। তবে তার এ দাবির সপক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি।

চুক্তিনামায় তার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দেওয়া আছে- এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘আমি ভোটার আইডি কার্ড করিনি।’ চুক্তির বিষয়টি শেষ পর্যন্ত স্বীকার না করলেও তিনি আশরাফুল আলম ও রিন্টু আনোয়ারের মধ্যেকার সম্পর্কের বিষয়টি স্বীকার করেন।

এদিকে, ঘুষ দিয়ে পদোন্নতি পাওয়া ছাড়াও আশরাফুল আলমের বিরুদ্ধে বিভাগীয় বিভিন্ন কাজে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। টাকার বিনিময়ে ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার নামে। এর আগে সারাবাংলার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এসব অভিযোগে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত লিখিত অভিযোগ পৌঁছেছে।

এদিকে, সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) দুদক জানিয়েছে, জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়ায় আশরাফুল আলম ও তার স্ত্রী সাবিনা আলমের সম্পদের হিসাব চেয়ে এর আগে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি নোটিশ দেয় দুদক। নোটিশে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে তাদের সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে বলা হয়। এরপর দুদকের সহকারী পরিচালক মেফতাহুল জান্নাত প্রাথমিক অনুসন্ধানে আশরাফুল-সাবিনা দম্পতির জ্ঞান আয় বহির্ভূত সম্পদের তথ্য পেয়ে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এবার তার সম্পদের অনুসন্ধানে দুদকের সহকারী পরিচালক সাইদুজ্জামানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে কমিশন। এবার যেকোনো মুহূর্তে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে গণপূর্তের এই কর্মকর্তাকে।

এসব বিষয়ে জানতে চেয়ে আশরাফুল আলমের মোবাইল ফোনে গণমাধ্যম থেকে দফায় দফায় কল করলেও তিনি রিসিভ না করে কেটে দেন। তার নম্বরে এসএমএস করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলীর মিডিয়াউইং কর্মকর্তা কল্যাণ কুমার কুন্ডুর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সার্ভিস রুল অনুযায়ী ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কথা বলা নিষেধ।’ সুত্র: সারাবাংলা।