দালালদের তালিকা প্রদানে সাড়া নেই রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর

দালালদের তালিকা প্রদানে সাড়া নেই রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর

বিদেশগামীদের সাথে প্রতারণা বন্ধে কথিত দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের তালিকা প্রণয়নে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কাছে তালিকা চেয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্তে সাড়া মেলেনি বেসরকারিভাবে বিদেশে জনশক্তি রফতানিকারক রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর। গত ৭ মার্চের মধ্যে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে তাদের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের তালিকা বিএমইটিতে জমাদানের নির্দেশনা প্রদান করলেও ফলাফল শূন্য। এ অবস্থায় কথিত দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের (পরিবর্তিত নাম স্থানীয় মার্কেটিং প্রতিনিধি) নামের তালিকা ৩১ মার্চে মধ্যে জমাদানের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো তাদের নির্ধারিত সারা দেশের স্থানীয় মার্কেটিং প্রতিনিধিদের নামের তালিকা বিএমইটিতে জমা না দিলে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির অনুকূলে বহির্গমন ছাড়পত্র প্রদান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো’র (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো: শামসুল আলম গতকাল বিকেলে নয়া দিগন্তকে বলেন, ৭ মার্চ পর্যন্ত কোনো এজেন্সি তালিকা পাঠায়নি। এ জন্য নতুন করে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বায়রার সাবেক সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব আবুল বাশার নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করি। বিদেশগামীরা নিজেরাই আমাদের অফিসে যোগাযোগ করে। আমার কার্ড দিয়ে কেউ যদি প্রতারণা করে তার দায় আমি নেবো। আমরা সরকারের ডাটাবেজ থেকে কর্মী নেবো, এতে সমস্যা কোথায়? প্রতিনিধির দায়িত্ব কেন আমরা নেবো?
বায়রাসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে বৈঠক করেই তো সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাহলে কেন বিরোধিতা করছেন আপনারা? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকার এনজিও’র দালাল বা সিলেক্টেডদের নিয়ে মিটিং করেছে। আমাদের ডেকে আলাপ-আলোচনা না করেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি সবার স্বার্থ সংরক্ষণ করে কোনো কিছু করা হয় তাহলে আমরা সরকারকে সহায়তা করতে প্রস্তুত।
তড়িঘড়ি করে কোনো কাজ নয়। বায়রায় এখন কমিটি নেই, প্রশাসক চালাচ্ছে। তাই এ বিষয়ে বায়রার সদস্যদের সাথে যৌথ মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হোক। আমরা বৈধভাবে কর্মী পাঠালেও কেন মানবপাচারে মামলা হবে? সরকারের অনুমতি নিয়েই তো পাঠাই!

এ বিষয়ে বায়রার সদ্য বিদায়ী মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, বায়রা’র প্রতিনিধি হিসেবে সর্বশেষ যে মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলাম, সেখানে এই তালিকা প্রদানের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত হয়নি। পরে বায়রার কমিটি ভেঙে দেয়া হয়। ওই মিটিংয়ে ছিলাম না। প্রতিনিধিদের তালিকা জমা দেয়া বাধ্যতামূলক করা সমীচিন নয়। আমি নিজেও এই তালিকা দেইনি। বায়রা’র নির্বাচন সামনে। নতুন নেতৃত্ব আসার পর এ ব্যাপারে আলোচনাসাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
এ বিষয়ে বিএমইটি’র মহাপরিচালক মো: শামসুল আলম বলেন, তাদের (রিক্রুটিং এজেন্সি) সাথে আলোচনা করেই আমরা বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু কর্মীদের স্বার্থে বাধ্যতামূলকভাবে এজেন্সিগুলোর প্রতিনিধির এই তালিকা নিতে হবে। আর এই রকম সিদ্ধান্তের সময় বায়রার নেতৃবৃন্দও ছিলেন।

বিশ্বের প্রায় পৌনে দুই শ’ দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার রয়েছে। যদিও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার। এসব দেশে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশের বেশি অবদান রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর। প্রতিটি দেশে জনশক্তি রফতানির জন্য অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির কথিত দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে বিদেশগামীরা প্রতারিত হন। অভিবাসন ব্যয়ও কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বৈধভাবে বিদেশে কর্মী পাঠাতে রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স দেয় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এসব প্রতিষ্ঠানের নামেই বিদেশে যান কর্মীরা।

কিন্তু দেখা যায়, যে এজেন্সির মাধ্যমে তারা বিদেশ যাচ্ছেন, তার নামও জানেন না অধিকাংশ কর্মী। তারা চেনেন এলাকার পরিচিত দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের। অথচ তাদের মাধ্যমেই লেনদেন করেই রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশ যাচ্ছেন। এতে করে দিনের পর দিন বেড়েই চলছে অভিবাসন ব্যয়। দালালদের খপ্পরে পড়ে নানা প্রতারণা ও হয়রানির খবর প্রতিনিয়তই দেখা যায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। তাই সরকার এসব মধ্যস্বত্বভোগীদের বৈধ প্রক্রিয়ায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করে। দালাল বা মধ্যস্বত্বভোগীদের সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির আওতায় আনার প্রক্রিয়া হিসেবে তাদের পরিবর্তিত নাম ‘স্থানীয় মার্কেটিং প্রতিনিধি’ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গত ৭ মার্চের মধ্যে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে তাদের প্রয়োজনীয়সংখ্যক এই মার্কেটিং প্রতিনিধি নিয়োগের নিমিত্তে রিক্রুটিং এজেন্সিকে নির্দেশনা প্রদানে সহযোগিতা করার জন্য বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিকে (বায়রা) চিঠি দিয়েছিল বিএমইটি। কিন্তু এতে কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি সাড়া দেয়নি।

তাই প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (কর্মসংস্থান শাখা-১) মোহাম্মদ শাহীন স্বাক্ষরিত আরেকটি চিঠি বিএমইটির ডিজি বরাবর প্রেরণ করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, ‘...সুষ্ঠু ও নিরাপদ অভিবাসন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ, দালালের দৌরাত্ম্য নির্মূল, রিক্রুটিং এজেন্টের বৈধ প্রতিনিধির তালিকা সংরক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে বায়রা প্রতিনিধির সাথে সর্বশেষ গত ৭ অক্টোবর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে বিএমইটি’র মহাপরিচালকের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি এতদ্বিষয়ে কাজ করছে। কমিটি গত ২২ অক্টোবর এ-সংক্রান্ত সভায় মিলিত হয়ে কতিপয় কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত/সুপারিশ গ্রহণ করে। মাঠপর্যায়সহ সর্বস্তরে দালালের দৌরাত্ম্য নির্মূল, বিদেশগামী কর্মীদের হয়রানি বন্ধ, অভিবাসন ব্যয় হ্রাস তথা অভিবাসন প্রক্রিয়াকে অধিকতর স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার আওতায় আনয়নের লক্ষ্যে রিক্রুটিং এজেন্টগুলোর সব পর্যায়ের বৈধ প্রতিনিধিদের তালিকা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি।’

বিএমইটি’র মহাপরিচালক বরারবর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, ‘...অবৈধ দালালদের প্রতারণা থেকে বিদেশ গমনে ইচ্ছুক কর্মীদের রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সব রিক্রুটিং এজেন্টকে তাদের বৈধ প্রতিনিধির নাম, ঠিকানা, ছবি, মোবাইল নম্বর ইত্যাদিসহ তালিকা সংরক্ষণ এবং আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে তা বিএমইটিতে দাখিলের নিমিত্ত সব রিক্রুটিং এজেন্টকে বিএমইটি কর্তৃক জরুরি নির্দেশনা প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। ওই সময়ের মধ্যে বৈধ প্রতিনিধির তালিকা দাখিলে ব্যর্থ হলে বিএমইটি সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্টের অনুকূলে বহির্গমন ছাড়পত্র প্রদান কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিএমইটি’র পরিচালক (উপসচিব-কর্মসংস্থান) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ভূঁইয়া বায়রাকে ফের চিঠি দেন। এ বিষয়ে মিজানুর রহমান ভূঁইয়া নয়া দিগন্তকে জানান, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা বায়রাকে চিঠি দিয়েছি। ২৫ মার্চের মধ্যে বিএমইটিতে তালিকা প্রদানের জন্য বলা হয়েছে। ৩১ মার্চ আমরা এই তালিকা মন্ত্রণালয়কে দেবো।