বঙ্গোপসাগরে একের পর এক লঘুচাপ

বঙ্গোপসাগরে একের পর এক লঘুচাপ

বঙ্গোপসাগরে একের পর এক সৃষ্টি হচ্ছে লঘুচাপ। তুলনামূলক শান্ত সেপ্টেম্বরেও ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেছে। গতকাল বুধবারও একটি লঘুচাপ সাগর থেকে স্থলভাগে উঠে এসেছে। ফলে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হয়ে গেল। বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা এত বেশি যে, খুব দ্রুততম সময়ে লঘুচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় হয়ে যাচ্ছে। দিন দিন বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে বলে উল্লেখ করে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এসব কারণে বঙ্গোপসাগরে ঘন ঘন লঘুচাপের সৃষ্টি হচ্ছে এবং তা থেকে ঘন ঘন নি¤œচাপ হচ্ছে এবং ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। এটা হচ্ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে। এজন্য বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা।

ঠিক একই কারণে সামনের দিনগুলোতে বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ অথবা নি¤œচাপ এবং তা থেকে ঘূর্ণিঝড় বাড়বে বলে উল্লেখ করে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরে অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কমপক্ষে দু’টি ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। এ বছরও বড় ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে। সেপ্টেম্বরে গোলাবের মতো দুর্বল ধরনের ঘূর্ণিঝড় এই আশঙ্কা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ গোলাব বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার মতো সব শক্তি নিয়ে আসেনি।

গত দু’দিন ধরে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপটি অবশেষে গতকাল সকালের দিকে স্থল ভাগে উঠে এসেছে, ফলে সারা দেশেই কম-বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। লঘুচাপটি স্থলভাগে উঠে এসেছে বলেই এর শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে, এটি আর শক্তিশালী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। একটা সময় বৃষ্টি ঝরিয়ে এটা দুর্বল হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিস বলছে, ঘূর্ণিঝড় গোলাব (গোলাপ) সৃষ্টি হওয়ার পরপরই গতকালকের লঘুচাপটি বঙ্গোপসাগরের সৃষ্টি হয়েছিল। এটি আর শক্তিশালী হতে না পেরেই স্থলভাগে উঠে এসেছে। এর প্রভাবে আগামী দু’দিন দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানী ঢাকা শহরে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হয়েছে। কিন্তু খুলনা বিভাগে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হয়ে গেছে। এর প্রভাবে গতকাল দেশের বিভিন্ন স্থানে অল্প হলেও বৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে সেপ্টেম্বরে লঘুচাপ সৃষ্টি হলেও সাধারণত ঘূর্ণিঝড় হয় না। ঘূর্ণিঝড় গোলাব এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটনা ছিল। বাংলাদেশের আবহাওয়া অফিসে সেপ্টেম্বরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দু’টি বর্ষাকালীন লঘুচাপ হতে পারে এবং তা থেকে একটি বর্ষাকালীন নি¤œচাপ হতে পারে। কিন্তু ঝড়ের পূর্বাভাস তারা দিতে পারেনি। বঙ্গোপসাগরে অক্টোবর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত কমপক্ষে দু’টি ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। এ বছরও বড় ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা রয়েছে। সেপ্টেম্বরে গোলাবের মতো দুর্বল ধরনের ঘূর্ণিঝড় এই আশঙ্কা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

কানাডার সাসকাচোয়ান ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ এ ব্যাপারে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরে নি¤œচাপ সৃষ্টি হওয়ার মতো যথেষ্ট পরিবেশ রয়েছে। সাধারণত সাগরের উপরিতলের পানির তাপমাত্রা ২৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলেই সেখানে লঘুচাপের সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরের উপরিতলের পানির তাপমাত্রা ৩১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।

তিনি জানান, সাধারণত সমুদ্রের পানির উচ্চতা, পানির উপরিতলের তাপমাত্রা এবং পানির যত গভীরে তাপমাত্রা ২৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে তার ওপর নির্ভর করে এই এলাকার সাগরের পানিতে কী পরিমাণ লঘুচাপ থেকে নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় হবে। বাংলাদেশের উপকূল সংলগ্ন দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে এপ্রিল থেকে মে এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে পানির তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। সাধারণত সমুদ্রের ৩০ মিটার গভীর পর্যন্ত পানির তাপমাত্রা ২৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরে আরো অনেক বেশি গভীরে পানির তাপমাত্রা ২৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পাওয়া যাচ্ছে। অনেকসময় ৫০ মিটার গভীর পর্যন্তও পানির তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি পাওয়া যায় বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। এসব কারণে বঙ্গোপসাগরে ঘন ঘন ঝড় ও নিম্নচাপ হচ্ছে। এটা নানা কারণে হচ্ছে বলে জানান, মোস্তফা কামাল পলাশ।

তিনি বলেন, এর একটি কারণ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন। অন্য কারণটি হলো গ্রিনহাউজ গ্যাসের কারণে বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া। প্রশান্ত মহাসাগরে ঘটে যাওয়া লা নিনার একটি প্রভাবও রয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরে লা নিনা সংঘটিত হলে ট্রেড উইন্ড স্বাভাবিকের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে থাকে। ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের গরম পানি অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার দিক থেকে এশিয়ার দিকে ধাবিত হয়ে থাকে। এটা যখন বঙ্গোপসাগরের দিকে আসে তখন বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ-নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে। মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, এসব কারণে বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ-নিম্নচাপ এবং ঝড় হয়ে যায়। বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ যত না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।

সাসকোয়ান ইউনিভার্সিটির গবেষক মোস্তফা কামাল এ বিষয়ে বলেন, বায়ুমণ্ডলে যে তাপমাত্রা প্রবাহিত হয় এটা শেষ পর্যন্ত স্থলভাগে থাকে না। গ্রিন হাউজ গ্যাসের কারণে তা উপরে গিয়ে ঠাণ্ডা না হতে পারে না এবং সমুদ্রের পানি সে তাপের ৮০ শতাংশের বেশি শোষে নয়। এই কারণেও সমুদ্রের পানিতে তাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকছে। লা নিনার কারণে যে ট্রেড উইন্ড হয়ে থাকে তার প্রভাবেও গরম পানি প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব দিক থেকে ক্রমশ পশ্চিম দিকে ভারত মহাসাগরে চলে আসে। বঙ্গোপসাগরের আকারের কারণে সেই গরম পানির প্রবাহের আঁচ এখানেও লাগে। ফলে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরের গরম পানির সাথে পূর্ব দিক থেকে আসা গরম পানি যোগ হলে সেখানে পানিতে নতুন আন্দোলনের সৃষ্টি করে এবং তাতে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়ে থাকে।

আবার প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল এলাকাজুড়ে গরমের কারণে সেখানকার পানি বেশি বাষ্পায়িত হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। তাতে আকাশে মেঘের সৃষ্টি হয়ে থাকে। যে এলাকায় মেঘের সৃষ্টি হয় সেখানকার সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম থাকে। সেই এলাকার অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা ও দূরবর্তী এলাকার গরম পানির প্রতিক্রিয়ায় গরম পানির এলাকা থেকে পানি ঠাণ্ডা পানির দিকে যেতে থাকে। এর যে একটি প্রভাব, তা-ও শেষ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে গিয়ে এসে পড়ে থাকে এবং বঙ্গোপসাগরের পানিতে চাপ সৃষ্টি হয়ে থাকে।

এমজে/