গোলাপে মন ভরে, পেট চলে না বরইতলীর চাষিদের

গোলাপে মন ভরে, পেট চলে না বরইতলীর চাষিদের

কক্সবাজার শহর থেকে ৬১ কিলোমিটার দূরে চকরিয়া উপজেলার বরইতলী ইউনিয়ন। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ইউনিয়নটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে। একসময় বরই চাষ বেশি হতো বলে ইউনিয়নের নামকরণ বরইতলী। তারপর শুরু হয় তামাকের আগ্রাসন। এক দশক ধরে তামাকের জায়গায় চলছে গোলাপের চাষ, ইউনিয়নের অন্য নাম এখন ‘গোলাপগ্রাম’।

মহাসড়ক দিয়ে যাত্রীবাহী বাস কিংবা পায়ে হেঁটে চলাচলের সময় নজরে পড়ে অসংখ্য গোলাপবাগান। বাতাসে ভেসে গোলাপের সৌরভ যখন নাকে লাগে কিংবা গাছে গাছে ফোটা লাল গোলাপের দৃশ্য নজরে আসে, তখন মন সতেজ হয়ে ‍ওঠে। সম্ভবত গোলাপ সবার প্রিয়, ভালোবাসার ফুল বলে।

 

বরইতলীর লামারপাড়ায় ৪০ শতক জমিতে একটি গোলাপবাগান করেন স্থানীয় নাছির উদ্দিন। রোববার দুপুরে বাগানে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটা গাছে ফুটেছে দুই থেকে পাঁচটি গোলাপ। বাগানে গাছ চার হাজারের বেশি।

নাছির উদ্দিন (৩২) বললেন, পাঁচ বছর আগে তিনি ৩ একর জমিতে এই গোলাপ চাষ শুরু করেছিলেন। করোনার দুই বছর গোলাপ বিক্রি মোটেও হয়নি। এ কারণে কয়েক লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। এখন চাষাবাদ কমিয়ে ৪০ শতকের বাগানের ফুলও ঠিকমতো বিক্রি হচ্ছে না। তিন-চার মাস ধরে ফুল বিক্রি হয়েছে দুই টাকার কমে। এখন ভালোবাসা দিবসে ফুলের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে ঠিক, পরদিন থেকে আবার কমে দুই টাকায় নেমে আসবে।

আক্ষেপের সুরে নাছির উদ্দিন বলেন, গোলাপে মন ভরে কিন্তু পেট ভরে না। গোলাপ চাষে লোকসান গুনতে গুনতে অনেকে পথে বসেছেন। শতাধিক গোলাপচাষি পরিবারের জীবন-জীবিকা হুমকিতে পড়েছে।

মঙ্গলবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এদিনে প্রিয়জনের হাতে গোলাপ তুলে দিতে চায় কমবেশি সবাই। এ কারণে গোলাপের চাহিদাও বেড়ে যায়। ভালোবাসা দিবসে বরইতলীর ৫১টি বাগান থেকে প্রায় ৭১ হাজার গোলাপ বিক্রির আশা করছেন চাষিরা। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ গোলাপ বিক্রি হবে চট্টগ্রাম মহানগরের চেরাগীপাহাড় এলাকায়। অবশিষ্ট ১০ শতাংশ গোলাপ বিক্রি হবে কক্সবাজার শহরসহ বিভিন্ন এলাকায়।

বরইতলী গোলাপ বাগান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন আগেও প্রতি ১০০ গোলাপ বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকায়। এ ক্ষেত্রে একটি গোলাপের দাম পড়ে ২ টাকা। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে গোলাপের দাম পাঁচ টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ টাকায়। ভালোবাসা দিবসে বরইতলীর ৫১টি বাগান থেকে বিক্রি হবে প্রায় ৭১ হাজার গোলাপ। গোলাপ বিক্রির বিপরীতে পাওয়া যাবে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। বলতে গেলে এ টাকায় কিছুই হয় না।

বরইতলীর সোনাইছড়ি খালের উত্তর পাড়ে মঈনুল ইসলামের এক একরের গোলাপবাগান রয়েছে। তিনি বলেন, করোনা মহামারি ও বিধিনিষেধে গত দুই বছর কোনো গোলাপ বিক্রি হয়নি। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে গাছের গোলাপ গাছেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এখনো গোলাপ নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট ফুল গাছে রাখা যায় না, গাছের ক্ষতি। তাই প্রতিদিন এই বাগান থেকেই অন্তত ৫০০ থেকে ১ হাজার গোলাপ কেটে ফেলে দিতে হচ্ছে।

দেখা গেছে, বরইতলীর উপরপাড়া, নামারপাড়া, খয়রাতিপাড়া, বরইতলী নতুন রাস্তার মাথা, মাইজপাড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় গোলাপের চাষ হচ্ছে। প্রতিটি বাগান থেকে কাটা হচ্ছে ১ হাজার থেকে ৩ হাজার গোলাপ।

মাইজপাড়ার একটি বাগানের মালিক সাইফুল আলম বলেন, রোববার সকালে তিনি বাগান থেকে ৩ হাজার ২০০টি গোলাপ কেটে চট্টগ্রাম পাঠিয়েছেন।

খয়রাতিপাড়ার চাষি আবদুর রহমান নিজের বাগান থেকে কেটেছেন ২ হাজার ৪০০ গোলাপ। আগামী একুশে ফেব্রুয়ারির দিনও চড়া দামে গোলাপ বিক্রি হবে বলে জানান তিনি।

চাষিরা বলেন, গোলাপের বাজার দখল করেছে কাগজের ফুল ও চায়না ফুল। গোলাপ একবার ব্যবহারের পর আর ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু কাগজের ফুল বা চায়না ফুল অন্তত চার থেকে পাঁচবার ব্যবহার করা যায়। বিয়েশাদি, সামাজিক অনুষ্ঠানে এখন কাগজের ফুল ব্যবহার করা হচ্ছে বেশি।

চাষিদের ভাষ্যমতে, দুই বছর আগেও বরইতলীতে প্রায় ২০০ একর জমিতে ২১০টি গোলাপবাগান ছিল। এখন মাত্র ৮৬ একরে ৫১টি বাগান টিকে আছে। তামাক চাষ ছেড়ে গোলাপ চাষে আসা চাষিরা জীবন বাঁচাতে পুনরায় তামাক চাষসহ নানা পেশায় ঝুঁকছেন।

তবে চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন বলেন, বরইতলী ও হারবাং এলাকায় ১৭৫ একর জমিতে গোলাপের চাষ হচ্ছে। করোনা ও বিধিনিষেধের কারণে গোলাপচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখন গোলাপের দাম পাওয়া যাচ্ছে। চাহিদাও বাড়ছে।