সংকট ইভিএম নিয়ে নয়, রাজনৈতিক দলের

সংকট ইভিএম নিয়ে নয়, রাজনৈতিক দলের

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক করার ক্ষেত্রে সংকট ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনকে (ইভিএম) কেন্দ্র করে নয়। এটি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট। ইভিএমে ভোটগ্রহণের কারচুপির প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তবু এ মেশিন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা চলছে।

রাজধানীর ঢাকা গ্যালারিতে এডিটরস গিল্ড আয়োজিত ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও ইভিএম’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা শনিবার এসব কথা বলেন।

তবে কয়েকজন বক্তা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সময় বিপুল টাকা ব্যয় করে এ মেশিন ব্যবহারের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা এ মেশিনের ওপর আস্থা সৃষ্টি করারও জোর দেন।

এডিটর গিল্ডের সভাপতি মোজাম্মেল বাবুর সঞ্চালনায় বৈঠকে বক্তব্য দেন- সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন, লেখক ও প্রযুক্তিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনীতি পর্যবেক্ষক অধ্যাপক হারুন অর রশীদ, বুয়েটের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল জব্বার খান, বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার প্রমুখ। বৈঠকে সূচনা বক্তব্য দেন এডিটর গিল্ডের প্রেসিডিয়াম সদস্য নাঈমুল ইসলাম খান।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য ইভিএম সাংঘর্ষিক নয় জানিয়ে অধ্যাপক হারুন অর রশীদ বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে ইভিএম ছিল না, তারপরও কিন্তু সেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। আবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম থাকলেও পরাজিত প্রার্থী ফল মেনে নিয়েছেন। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক মাঠে ভারসাম্য থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশন, সরকার, এমনকি জনগণের ওপরও বিএনপির আস্থা নেই।

‘একটা জায়গায় তাদের আস্থা আছে- তা হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদই ওই ব্যবস্থা হত্যার জনক ছিলেন। তবে আমার বিশ্বাস, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। যদি তারা অংশ না নিত তাহলে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়েই বক্তব্য দিত, ইভিএম নিয়ে নয়। যেসব রাজনৈতিক দল বিরোধিতা করছে তারা ইভিএমের জন্য নয়, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কোনো ব্যবস্থা করে দিতে পারলে ইভিএম নিয়ে আপত্তি থাকবে না।’

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ইভিএমে অনেকের ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে, সময় লাগতে পারে। এটি ভোটারদের জন্য বড় অন্তরায়। ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে বিমানবন্দরেও সমস্যায় পড়তে হয়।

ইভিএমে ভিভিপ্যাটের (ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইলিং) গুরুত্বের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে ভোটারদের চাপা বোতাম অনুযায়ী প্রিন্ট দেখলে তাদের আস্থা বাড়বে। ভারতে ইলেকট্রনিক ভোটিংয়ের বিষয়টি সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত গড়ালে সেখানকার আদালত ২০ শতাংশ পর্যন্ত ভিভিপ্যাটের প্রিন্ট টালি করার পরামর্শ দেন। এ ছাড়া এত টাকা খরচ করে যত ভালো ইভিএমই উদ্ভাবন করা হোক, ভোটারদের আস্থা না থাকলে যত ভালো ভোটই হোক তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, আমি ইভিএমের বিভিন্ন অংশ খুলে দেখাতে বলেছিলাম। যে মেশিনটি দেখানো হয়েছে, তার হার্ডওয়্যার থেকে শুরু করে সবকিছু দেখেছি। তারা খুব সুন্দরভাবে এটি করেছেন। ক্যাবলসহ সবকিছু স্পেশালি কাস্টমাইজড করে তৈরি করা। অন্য কোনো যন্ত্রাংশ বা ডিভাইস এতে যুক্ত করার সুযোগ নেই। এজন্য উদ্ভাবকদের অভিনন্দন জানাতে চাই।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন বলেন, আগের ইভিএমের চেয়ে এখনকার মেশিনগুলো অনেক উন্নত। সব ধরনের অনিয়ম বন্ধে এটি আনা হয়েছে। কারও সন্দেহ থাকলে নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন। একটিতে না হলে ৫০টি মেশিন পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

অধ্যাপক আব্দুল জব্বার খান বলেন, ইভিএমের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সবকিছু লকড। তারপরও কথা রয়েছে। এ মেশিন সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে না। এটি মাঠপর্যায়ের মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে।

ইভিএম উদ্ভাবন কমিটির সদস্য ও বুয়েটের শিক্ষক অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ভোটকেন্দ্র দখল, একজনের ভোট আরেকজনের দেওয়া, আগের রাতেই ভোট দেওয়া, ভোটের পর ফল পরিবর্তন হয়ে যাওয়া- এসব বন্ধ করতেই ইভিএম আনা হয়েছে। ইভিএমে ভোটের স্বচ্ছতার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ইন্টারনেটসহ কোনো ধরনের সংযোগ নেই। কোনো কারচুপির সুযোগ নেই।

দিলীপ কুমার সরকার বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন তখনই হবে যখন অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার আস্থা আসবে। নির্বাচন কমিশনের ওপর সেই আস্থা আছে কিনা, সেটি বেসিক প্রশ্ন। এক্ষেত্রে ইভিএমে ভোট হওয়ার পরও সীমাবদ্ধতাগুলো আমরা দেখেছি। এর মধ্যে বুথ ক্যাপচারও আছে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে আঙুলের ছাপ ওভাররাইটের ক্ষমতা ১ শতাংশ না ৫০ শতাংশ দেওয়া হলো তা তো বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। এ একটা বিষয়ই নির্বাচনের ফলাফল উলটে দিতে পারে। এজন্য ইভিএম নিয়ে সন্দেহ আছে। ব্যালটের চেয়ে ইভিএমে ভোট কম পড়ার ঘটনাও আমরা দেখেছি। এখন নির্বাচন কমিশনকে আস্থা ফেরাতে হবে।

মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মী খুশি কবীর বলেন, ২০ বছর ধরে যত মেশিনে আমি ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়েছি, এক্ষেত্রে আমার সমস্যা হয়ে আসছে। ইভিএমে ভোট দিতে গেলেও তাই হবে। এখন ইভিএম সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুবই কম। অনেক দেশে এটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মূল বিষয় হলো, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এজন্য সবার আস্থা ফেরাতে হবে।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক মনিরা খান বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে এত হাজার কোটি টাকা দিয়ে কেন ইভিএম কেনার কথা হচ্ছে, দেশবাসীর পক্ষ থেকে আমি সেই প্রশ্নটি রাখতে চাই।