গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিতে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন: রেহমান সোবহান

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিতে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন: রেহমান সোবহান

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রয়োজন। সেখানে প্রার্থীদের নির্বাচন করতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে না। পেশিশক্তির ব্যবহার করতে হবে না। সাধারণ প্রার্থীরা নির্বাচিত হতে পারবেন।

শনিবার রাজধানীর ফার্মগেটে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় উন্নয়ন ও স্থানীয় বাস্তবতা নিয়ে আয়োজিত এক গণশুনানিতে রেহমান সোবহান এসব কথা বলেন। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এ সম্মেলনের আয়োজন করে।

নাগরিক প্যানেলের সভাপতিত্ব করেন রেহমান সোবহান।

১৫ বছর ধরে একই ধরনের নাগরিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা হলেও সমাধান হচ্ছে না বলে মনে করেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে চলা নাগরিক সমস্যাগুলোর সমাধান হচ্ছে না। এর মানে পুরো সিস্টেমেই (ব্যবস্থাপনায়) সমস্যা আছে।

রেহমান সোবহান বলেন, দেশে গত কয়েক বছরে উন্নয়ন হয়েছে—এটি অস্বীকার করা যাবে না। তবে পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, দলিত, হিজড়া, চা–বাগানের শ্রমিকদের সমস্যাগুলো অনেক বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে, সবই চিহ্নিত সমস্যা। স্থানীয় মাস্তান, ক্ষমতাশালীরা কেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জনগণের জমি দখল করবে? এসব সমস্যার সমাধান তো প্রয়োজন। এটি বদলাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রয়োজন।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, সরকার ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে বলেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ করছে। এখনো নানা ক্ষেত্রেই সমস্যা আছে, তা স্বীকার করতেই হবে। দুর্নীতিমুক্ত, সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছে—এমনটা বলা যাবে না। সমালোচনার জায়গা থাকলেও উন্নয়ন হয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী ও নীলফামারী-২ আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর বলেন, উন্নয়নের পাশাপাশি নানা খাতে সমস্যা আছে, এটি বাস্তবতা। একসময় নীলফামারীর মতো জেলা ছিল মঙ্গাপীড়িত। মঙ্গার তিন মাস ছিল দুর্বিষহ। এখন মঙ্গা জাদুঘরে চলে গেছে। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক অনিয়ম হয়। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় দায়িত্বশীল নাগরিকদের ভূমিকা রাখতে হবে, সামাজিক প্রতিরোধ দরকার।

প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান সাবেক বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে যেসব সমস্যার কথা বলা হয়েছে, সেগুলো তো নাগরিকের অধিকার। এগুলো তাদের প্রাপ্য।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, কোচিং–বাণিজ্য বন্ধ করতে উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ এসেছে। কিন্তু শিক্ষা আইন এখনো আলোর মুখ দেখেনি। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা কেন শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেখবে না? সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দয়া–দাক্ষিণ্যের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা পরিচালনা করছে।

জবাবদিহির অভাবে উন্নয়নের নানা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক, আঞ্চলিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক—চার পর্যায়ের প্রান্তিকতায় আটকে আছি। সব পর্যায়ের প্রান্তিকতা দূর করতে হবে।’

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জনগণ এখনো পরিচয়ের চক্রে ঘুরছেন। তারা কি আদিবাসী, নাকি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী? বাংলাদেশি, নাকি বাঙালি? কেউ তো তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদীও বলছেন।’

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জিত হলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মতো মৌলিক সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, এসডিজিকে স্থানীয়করণ করতে হবে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, দেশের দলিত ও হরিজন জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা প্রয়োজন।

এ শুনানির আগে রংপুর, খুলনা, টাঙ্গাইল, সিলেট, ঠাকুরগাঁও, রাঙামাটি ও চট্টগ্রামে নাগরিক পরামর্শ সভা হয়। তাতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার প্রতিনিধিরা নানা সমস্যা তুলে ধরেন। এসডিজি বাস্তবায়নে করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়। শুনানিতে এসব জেলা থেকে আগত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

নাগরিক সভাগুলোয় যেসব বিষয় উঠে আসে, তার মধ্যে রয়েছে বেকারত্ব বড় সমস্যা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ, নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হলেও নারী ও শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি, শিক্ষার হার বাড়লেও প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবার অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ডিজিটাল মাধ্যম, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিরূপ প্রভাব এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়।

শুনানি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হচ্ছে বেশি। উন্নয়ন সুষমভাবে সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। আগামী দিনের যে নির্বাচনী পরিস্থিতি সামনে আসছে, তা নিয়ে মানুষের মনে শঙ্কা আছে। উন্নয়ন, জীবন-জীবিকা যেন বিঘ্নিত না হয়, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যেন বিঘ্নিত না হয়। জনগণের মনে শঙ্কা ও আশাবাদ—দুটিই রয়েছে।