রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে সংকটে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে সংকটে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশে যে খাতগুলোয় সবচে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে তার মধ্যে অন্যতম বিদ্যুৎ খাত।

যুদ্ধের বছরে টালমাটাল হয়ে পড়ে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজার। রেকর্ড দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি করতে ব্যর্থ হয় বাংলাদেশ, ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সংকট দেখা দেয়। একদিকে উৎপাদন কমানো হয় আবার জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় রেকর্ড হারে।

বলা হচ্ছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশে জ্বালানি খাতের ওপরেই সবচে বেশি বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

বাংলাদেশ যেহেতু প্রাথমিক জ্বালানির সিংহভাগই আমদানি করে চলে, তাই জ্বালানি খাতে গভীর সংকট সৃষ্টি করে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধের বছর জ্বালানি খাতে আমদানি করতে গিয়ে ডলার সংকটেও পড়েছে বাংলাদশ।

জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজার তদারকি এবং গবেষণার সাথে যুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের হিসেবে দেখা যায় আন্তর্জাতিক স্পট মার্কেটে ২০২১ সালের মার্চ মাসে যে এলএনজির দাম গড়ে ৭ ডলারে মধ্যে ছিল, সেটি ২০২২ সালে ৫৪ ডলার পর্যন্ত উঠে যায়।

বাংলাদেশে সরকারে জ্বালানি উপদেষ্টা জানান সর্বোচ্চ ৩৫ ডলার দিয়ে গ্যাস কেনার পর বাংলাদেশ স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমাদানি বন্ধ করে দেয়।

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বিবিসিকে বলেন, “চতুর্দিক থেকে একটা অভিঘাত এলো। এক সময় আমরা এলএনজি পাঁচ ডলারে পর্যন্ত কিনেছি। সেখানে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ ডলারে। সেজন্য আপনারা জানেন আমরা কিছুকালের জন্য লোডশেডিংয়ে যেতে বাধ্য হলাম। এবং বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হলো। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কারণে ছোট-খাটো শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়লো। তারপরে আবার গ্যাসের দাম বাড়ালাম। গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে আবার শিল্প প্রতিষ্ঠান সব জায়গায়, অনেকটা ব্লাড প্রেসারের মতো রন্ধ্রে রন্ধ্রে এফেক্টগুলা চলে গলে হার্মফুল এফেক্ট ((ক্ষতিকর প্রভাব)"।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে সবচে বড় প্রকল্পের বাস্তবায়নেও প্রভাব ফেলেছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়ার অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তা নির্মানাধীন রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাস্তবায়নেও প্রভাব ফেলেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা।

“দুদিকে আমাদের হলো চ্যালেঞ্জ এসেছে। একটা হলো রূপপুরের পাওয়ারকে ইভাকুয়েট করতে যে ট্রান্সমিশন (সঞ্চালন) লাইন লাগে সেটা আমরা পিছিয়ে পড়ে গেছি। যদিও কোভিডের কারণেও এটা কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। আর আরেকটা হলো যে আমাদের যে জিনিসপত্র আসবে এটা নিয়ে আপনারা যানেন যে ঝামেলা হয়েছে। যেমন একটা জাহাজ ওটা ভিড়তে পারেনি। কিন্তু অন্যান্য জাহাজ কিন্তু নিয়ে এসেছে। নিষেধাজ্ঞা জিনিসটা এমনভাবে সবার মধ্যে ছড়িয়েছে যে এটা কোনোভাবেই কিছু করা যাবে না”, বলেন জ্বালানি উপদেষ্টা।

ইউক্রেন যুদ্ধের বছরে ডলার সংকট এবং উচ্চমূল্যের কারণে সব ধরনের জ্বালানি আমদানি করতে বাড়তি সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। উৎপাদন শুরু করে কয়লা ভিত্তিক পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন ব্যহত হয়েছে।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, এ যুদ্ধের বছরে বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক তেলভিত্তিক ও গ্যাসভিত্তিক সবগুলোতেই বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

“গ্যাসভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে সেগুলোতো গ্যাসের অভাবে চালানো যায়নি। যেগুলো নির্মানাধীন আছে সেগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে বাস্তবায়ন ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। কারণ, আল্টিমেটলি জ্বালানি পাওয়া না গেলেতো বিদ্যুৎকেন্দ্র এসে লাভ নেই। সবকিছু মিলিয়ে আমি মনে করি যে জ্বালানি খাতের অভিঘাতটাই হচ্ছে সবচে ক্রুশিয়াল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।”

মি. হোসাইন বলেন, পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিদ্যুৎ কিনতে উৎপাদন কোম্পানিগুলোর কাছে বিপুল অঙ্কের আর্থিক দেনায় পড়ে।

“বিপিডিবি আমাদের যে বিদ্যুৎ কেনে জেনারেশন কোম্পানি থেকে সেই দামে বিক্রি করতে পারে নি ইউটিলিটির (বিতরণ কোম্পানি) কাছে। ফলে বিপিডিবির ক্যাশ ডেফিসিট কিন্তু এমন একটা জায়গায় গেছে যেখানে সরকারের সাবসিডি অ্যালোকেশন (ভর্তুকী) দিয়ে সেটা কাভার করতে পারে নাই। সবমিলিয়ে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের নিয়মিত অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়।”

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এখনো থামেনি। তবে জ্বালানির দাম কিছুটা কমে বর্তমানে স্পট মার্কেট এলএনজির দাম প্রতি ইউনিট গড়ে ২০ ডলারের মত। তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৮০ ডলারের কাছাকাছি। আর প্রতিটন কয়লার দাম ২১০ ডলার।

এ বাস্তবতায় এলএনজি আমদানি শুরু করেছে সরকার। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু করতে হচ্ছে। সেচ ও বিদ্যুতের জন্য দরকার হবে ডিজেল।

বর্তমান জ্বালানি খাতের পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছিলেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ম তামিম।

“ডলার সংকট এবং দাম বৃদ্ধি এই উভয় সংকটে পড়ে বাংলাদেশের জ্বালানি খাত এই মুহূর্তে একটা খুবই নাজুক পরিস্থিতিতে আছে আমি বলবো। এই গ্রীস্মকালে কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে। আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা আছে, আমাদের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো তৈরি হয়ে গেছে। বিশেষ করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াটের মতো অতিরিক্ত বিদ্যুৎ আসছে। তার মানে আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা আছে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জটা হলো জ্বালানি সংগ্রহ করা, প্রাথমিক জ্বালানি সংগ্রহ করা। সেখানে গ্যাস আমদানি করতে হবে এবং কয়লা আমদানিও করতে হবে। তো এটার টাকা সংস্থান করাটাই হলো সবচে বড় চ্যালেঞ্জ।”

একদিকে বিপুল পরিমান জ্বালানির আমদানির প্রয়োজনীয়তা, অন্যদিকে ডলার সংকট এখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা। সেচ মৌসুম, গ্রীষ্মের গরম এবং রমজান মাসে একসঙ্গে এবার বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি করবে। বিদ্যুৎ বিভাগের উৎপাদন পরিকল্পনা এবং চাহিদা জোগানের এক হিসেবে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে ২৪ হাজার ১শ ১৪ মেগাওয়াট।

এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক ১১,০১৯ মেগাওয়াট, কয়লা ভিত্তিক ৩০৫২ মেগাওয়াট, সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ডিজেল চালিত ১২শ ছয় মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েলে সরকারি ১৩৩৮ মেগাওয়াট এবং বেসরকারি খাতে ৪,৯০২ মেগাওয়াট।

এছাড়া জলবিদ্যুৎ ২৩০ মেগাওয়াট, সৌর ৪৫৯ মেগাওয়াট এবং আমদানি সক্ষমতা ১৯০৮ মেগাওয়াট।

বিদ্যুত জ্বালানি খাতের সংকট মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, “এটা দামের ওপর নির্ভর করবে। এলএনজি আমদানিতে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি আছে ওমান ও কাতারের সঙ্গে। এছাড়া পুরোটা নাই। স্বল্পমেয়াদে যদি আমরা আনতে পারি, আমাদের সামর্থ্যে হয়, তাহলে ইনশাআল্লাহ এটা বড় কোনো সমস্যা হবে না। যদি এলএনজির দাম এভাবে থাকে, তাহলে আমরা চেষ্টা করবো ১৫ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে। পায়রা, রামপাল, আদানি এগুলো আসলে আমাদের ক্যাপাসিটি (সক্ষমতা) অনেক বাড়বে”।

আর গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা হতে পারে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো। গ্রীষ্ম মৌসুমে এ পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তেল গ্যাস ও কয়লা প্রয়োজন হবে।

বিপিসির কাছে ৭৭,৪০০ মে.টন ফার্নেস অয়েল এবং ৬৬,১০০ মেট্রিক টন ডিজেলের চাহিদা জানানো হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে চাহিদামতো নিজেদের তেল আমদানি করার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে।

এ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও আমদানি ছাড়াও কৃষি শিল্পের জ্বালানি আমদানি করতে চলতি অর্থবছরেই কয়েক বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে।

জ্বালানির চাহিদা পূরণে আমদানি নিশ্চিত করতে ডলার সরবরাহের ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায় ইতিবাচক বলেও জানা যাচ্ছে। তবে ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধে গতি প্রকৃতি এবং বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম আবারো বেড়ে গেলে প্রাথমিক সংকটে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। -বিবিসি বাংলা