রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প কি অনিশ্চয়তায় পড়ছে

রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প কি অনিশ্চয়তায় পড়ছে

ইউক্রেনে হামলার কারণে মস্কোকে আরও চাপে ফেলতে চায় ওয়াশিংটন। তারই ধারাবাহিকতায় রাশিয়ার ৮০ প্রতিষ্ঠান ও একক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সদ্য দেওয়া এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় অন্যতম প্রতিষ্ঠান রোসাটম। এতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে রোসাটমের তত্ত্বাবধানে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন নিয়ে। সম্প্রতি রোসাটমের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ঢাকাকে কূটনৈতিক পত্র পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে জানতে চাইলে রোসাটম এক ই-মেইল বার্তায় সমকালকে জানায়, রোসাটমের সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নকে প্রভাবিত করবে না। বরং এই প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে রোসাটম।

রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করেছে তাদের ওয়েবসাইটে। এতে বলা হয়, রাশিয়ার যেসব প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি বা অন্য দেশের প্রতিষ্ঠান ইউক্রেন যুদ্ধে মদদ দিয়েছে বা দিচ্ছে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ তুলে চীনের প্রতিষ্ঠান ‘হেড অ্যারোস্পেস টেকনোলজি’ এর বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। চীনের প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে– তারা ইউক্রেনের ওপর থেকে স্যাটেলাইট দিয়ে ছবি তুলে রাশিয়াকে সরবরাহ করেছে।গত ১২ এপ্রিল ৮০ প্রতিষ্ঠান ও একক ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তালিকা প্রকাশ করা হয়। এ তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশে থাকা সম্পদ, ব্যাংক হিসাবসহ সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা রাশিয়ার অন্যতম ধনকুবের ও ওলিগার আলিসের উসমানোভের বিশ্বের অন্যতম দামি প্রমোদতরী ইতোমধ্যে জব্দ করেছে জার্মানি।

রোসাটমের সংশ্লিষ্ট পাঁচটি প্রতিষ্ঠান এবং রোসাটম ওভারসিসের প্রেসিডেন্ট ইভজেনি পাকেরমানভের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। নিষেধাজ্ঞায় থাকা রোসাটমের প্রতিষ্ঠানগুলো হলো– দ্য ফেডারেল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড প্রোডাক্টশন সেন্টার এম.ভি. প্রোটসেনকো স্টার্ট প্রোডাকশন অ্যাসোসিয়েশন, রোসাটম ওভারসিস, কভরভ মেকানিক্যাল প্লান্ট (কেএমজেড), ভ্লাদিমির টচম্যাশ এবং জেএসসি নাউচানো-ইসলেডোভাটেলস্কি আই কনস্ট্রাক্টরস্কাই ইনস্টিটিউট মনটাজনয় টেকনোলজি অ্যাটোমসট্রয়। দ্য ফেডারেল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড প্রোডাক্টশন সেন্টার এম.ভি. প্রোটসেনকো স্টার্ট প্রোডাকশন অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠানকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে রাশিয়ার অর্থনীতিতে প্রতিরক্ষা এবং এ-সংক্রান্ত পণ্য সহযোগিতার জন্য। এ প্রতিষ্ঠানটি পরমাণু নিয়ে একটি জটিল প্রযুক্তি উৎপাদন করেছে বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছে।

মার্কিন নথিতে বলা হয়েছে, রোসাটম ওভারসিস প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাশিয়ার সরকারের হয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি রোসাটমের রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য পূরণে কাজ করছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র উন্নয়ন, নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি বৈশ্বিক পরমাণু বাজারে রাশিয়াকে শীর্ষস্থান ধরে রাখতে সহযোগিতা করছে। এ প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য ইভজেনি পাকেরমানভের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ভ্লাদিমির টচম্যাশ ও কভরভ মেকানিক্যাল প্লান্ট (কেএমজেড) পরমাণু বিদ্যুৎ ও পরমাণুসংক্রান্ত সামগ্রী ও সরঞ্জাম উৎপাদন করে। যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাশিয়া সরকারকে সহযোগিতা করছে। ফলে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

মার্কিন নথিতে আরও বলা হয়, জেএসসি নাউচানো-ইসলেডোভাটেলস্কি আই কনস্ট্রাক্টরস্কাই ইনস্টিটিউট মনটাজনয় টেকনোলজি অ্যাটোমসট্রয় পরমাণু সংক্রান্ত প্রযুক্তি উন্নয়ন, নতুন অবকাঠামো নির্বাচনসহ ডিকমিশনিংয়ের কাজে জড়িত। যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাশিয়া সরকারকে সহযোগিতা করছে। ফলে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, রোসাটমের যে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তাদের সঙ্গে কাজ না করতে পারলে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ কে এগিয়ে নেবে, তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ ৭০ শতাংশের ওপর কাজ সম্পন্ন হলেও এখনও অনেক পণ্য ও যন্ত্রাংশ আমদানি বাকি রয়েছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব সামগ্রী কীভাবে এবং কোথা থেকে জোগাড় হবে তা অনিশ্চিত। শুধু এক রুশ জাহাজের নিষেধাজ্ঞার কারণে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিছু সরঞ্জাম পেতে প্রায় তিন মাস দেরি হয়েছে। এখন এ নিষেধাজ্ঞা প্রকল্পটি যথাসময়ে বাস্তবায়নে বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে। সমস্যা নিয়ে দরকষাকষি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই বলে মনে করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।

মার্কিন এ নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা সব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে। সেই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞায় থাকা কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সঙ্গে সুবিধা, তাদের ব্যবসায় অবদান রাখা, অর্থায়ন, পণ্য ক্রয় বা সেবাগ্রহণ করে থাকলে সেই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি একই ধরনের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে। তবে কেউ যদি যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থেকে লাইসেন্স নিয়ে থাকে অথবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট কার্যালয় থেকে অব্যাহতি পেয়ে থাকে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর এ নিষেধাজ্ঞা বলবত হবে না।রোসাটমের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশে কি প্রভাব পড়বে– জানতে চাইলে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র শন ম্যাকিনটোশ সরাসরি কোনো জবাব দেননি। এক ই-মেইলে তিনি সমকালকে জানান, নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজেদের মধ্যে কূটনৈতিক পত্র আদান-প্রদান করে থাকে। কূটনৈতিক পত্রের বিষয়বস্তু প্রকাশ করা হয় না।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে রোসাটমের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে যে কূটনৈতিক পত্র দেওয়া হয়েছে, সেখানে রূপপুরের অর্থ পরিশোধের বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করতে চায় তারা। এ বিষয়গুলো সংশ্লিষ্টদের জানাতে গত মঙ্গলবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা সিদ্ধান্ত নেবে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্বিপক্ষীয় রাজনৈতিক সম্পর্ক ঠিক রাখতে কাজ করবে এবং করছে। বাংলাদেশ কখনও কারও কাছে দেনায় পড়েনি। কিন্তু রাশিয়ার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ দেনায় পড়ে গিয়েছিল। তা কাটিয়ে উঠতে চীনের মাধ্যমে রাশিয়ার দেনা পরিশোধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, রূপপুরের অর্থ পরিশোধের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।রোসাটমের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব ও করণীয় জানতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য চাওয়া হলেও প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।এ নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান সমকালকে বলেন, বিষয়টি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়নি।

ঢাকার রাশিয়া দূতাবাসের একটি সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্র যেসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তাতে অসন্তুষ্ট রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞাটি দিয়েছে সেটি দ্বিপক্ষীয়। জাতিসংঘ থেকে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। ফলে এ নিষেধাজ্ঞা মানার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বাংলাদেশের। দ্বিপক্ষীয় নিষেধাজ্ঞা মানতে বাধ্য করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইনের অমান্য করেছে। আর মস্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক কূটনৈতিক জানান, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়েছে।

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করা হচ্ছে। খরচ হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দেবে ২২ হাজার ৫২ কোটি ৯১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। রাশিয়া থেকে ঋণ সহায়তা হিসেবে আসছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রোসাটমের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাটোমসট্রয় এক্সপোর্ট।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজের অগ্রগতি ৭০ শতাংশের বেশি। ২০২৪ সালের শেষ দিকে উৎপাদনে আসতে পারে প্রথম ইউনিট। দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৫ সালে।  এ প্রকল্পের দুটি ইউনিটে ব্যবহৃত হবে টিজেডভি ১২০০-২ টার্বাইন জেনারেটর। এগুলোর নকশা প্রণয়ন ও নির্মাণ করেছে রুশ প্রতিষ্ঠান পাওয়ার মেশিন্স। মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের দুটি ইউনিট স্থাপিত হচ্ছে থ্রিপ্লাস বা তৃতীয় প্রজন্মের ভিভিইআর-১২০০ রিয়্যাক্টর দিয়ে।-সমকাল