নির্বাচন করতে মন্ত্রী আমাকে এখানে এনেছেন: চারঘাটের ওসি

নির্বাচন করতে মন্ত্রী আমাকে এখানে এনেছেন: চারঘাটের ওসি

থানা কম্পাউন্ডে নিজের বিশ্রামকক্ষে-কারাগারে থাকা এক ‘মাদক ব্যবসায়ীর’ স্ত্রীর সঙ্গে রাজশাহীর চারঘাট থানার ওসি মাহবুবুল আলমের মুখোমুখি আলাপের একটি অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়েছে।

সেখানে তিনি বলেছেন, নির্বাচন করতে মন্ত্রী (পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) আমাকে গাইবান্ধা থেকে চারঘাট থানায় নিয়ে এসেছেন। শুধু তাই নয়, ৫ লাখ টাকায় মাদক ব্যবসার অনুমতি এবং দুই লাখ টাকা দিলে জেলা ডিবির দুই কর্মকর্তাকে বদলির ব্যবস্থা করবেন বলেও শোনা গেছে তাকে।

ওসির অডিও ক্লিপ ফাঁসের ঘটনায় রাজশাহী জেলা পুলিশে তোলপাড় চলছে। যে নারীর সঙ্গে ওসি বসে এসব খোশ আলাপ জমিয়েছিলেন, সেই নারী শনিবার দুপুরে ওসি মাহবুব, ডিবির পরিদর্শক আতিকুর রেজা সরকারসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লিখিত একটি অভিযোগও দিয়েছেন। 

অভিযোগে ওই নারী দাবি করেছেন, ডিবি পুলিশ তার স্বামীকে সাজানো মাদক মামলা জড়িয়ে গ্রেফতার করেছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওসি মাহবুব মাদক কারবারির স্ত্রীর সঙ্গে যেসব আলাপ করেন তা গোপন রেকর্ডিং যন্ত্রে রেকর্ড করা হয় বলে জেলা পুলিশ কর্মকর্তাদের ধারণা। মোট ৬ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের অডিওতে ওসির কথোপকথনে উঠে এসেছে পুলিশের ভেতরের চাঞ্চল্যকর অনেক অজানা কাহিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে ওসি থানা কম্পাউন্ডে তার শয়নকক্ষে ডেকে নিয়ে সাহারা বেগম (২৮) নামে ওই নারীর কাছে ৭ লাখ টাকা দাবি করেন। শনিবার সকালে পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত আবেদন করার পর অভিযোগকারী সাহারা বেগম ভয়ে আত্মগোপনে আছেন।

জানা গেছে, গৃহবধূ সাহারা বেগম রাজশাহীর চারঘাট থানার চামটা গ্রামের আব্দুল আলিম কালুর স্ত্রী। মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়ে কালু কিছু দিন ধরে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি আছেন। 

সাহারা বেগমের অভিযোগ, স্থানীয় প্রতিপক্ষের দ্বারা ম্যানেজ হয়ে জেলা ডিবির পরিদর্শক আতিকুর রেজা সরকারের টিম তার স্বামীকে মাদক উদ্ধারের সাজানো মামলায় গ্রেফতার করেন কিছু দিন আগে। এই মামলার তদন্তের বিষয়ে সহায়তা চাইতে সাহারা বেগম ও তার ছেলে রাব্বী ওই দিন চারঘাট থানার ওসির কাছে যান। 

এসপিকে দেওয়া অভিযোগে সাহারা বেগম বলেন, গত ইউপি নির্বাচনে চারঘাটের শলুয়া ইউপির ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য পদে ভোট করেছিলেন। এই নির্বাচন কেন্দ্র করে স্থানীয় একটি পক্ষের সঙ্গে সাহারার স্বামী কালুর বিরোধ হয়। ওই প্রতিপক্ষ ডিবি পরিদর্শক আতিকুর রেজা সরকারকে ম্যানেজ করে তার স্বামীকে মাদকের সাজানো মামলায় গ্রেফতার করান। নারীর দাবি, তার স্বামীকে ডিবি পুলিশ ফাঁসিয়েছে। 

এদিকে ফাঁস হওয়া ওই অডিও রেকর্ডে ওসি মাহবুবুল আলমকে বলতে শোনা যায়, ‘নির্বাচন করতে মন্ত্রী (পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) আমাকে গাইবান্ধা থেকে চারঘাট থানায় নিয়ে এসেছেন। আমি তার কথা ছাড়া আর কারও কথা শুনি না। 

চারঘাট এলাকায় গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের ধরে মামলা দেওয়ার কারণে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একজন পরিদর্শকের সমালোচনা করেন ওসি। তিনি বলেন, আমাকে দুই লাখ টাকা দেন, কালকেই ডিবির আতিককে বদলি করে দেব।
এর পর গৃহবধূ সাহারা বেগমকে ওসি বলেন, আপনার স্বামী আমার অনেক ক্ষতি করে জেলে গেছে (ওসির বিরুদ্ধে এসপি অফিসে অভিযোগ করেছিলেন কালু)। এবার আপনার পরিবারের কাউকে ধরলে ১০ লাখ টাকার কমে ছাড়তে পারব না।
এর পর ওসি বলেন, এখনো তোমার গায়ে আমি আঁচড় দিইনি। বহুত ফাঁকি দিয়েছ। কালকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে আসবা। এখন সে রকম সময় নয় যে কেউ পয়সা খায় না। সবাই পয়সা খাচ্ছে। এমন কেউ বাদ নেই যে পয়সা খাচ্ছে না। পুরো জেলা পয়সা খাচ্ছে। এখানে আমার থানা চালাতে মাসিক অনেক টাকা লাগছে। আমি স্যারকে কথা দিয়ে এসেছি। স্যারকে বলেছি, এখানে মাদক ছাড়া টাকার আর কোনো উৎস নেই।

ওসি আরও বলেন, ‘মুক্তার বিরুদ্ধে (চারঘাটের মাদকসম্রাট ও নারীর প্রতিপক্ষ) এখন অ্যাকশন নিতে পারব না, শুভর বিরুদ্ধেও (ছাত্রলীগ নেতা ও মাদক কারবারি) অ্যাকশন নিতে পারব না। তোমরা ৫ লাখ টাকা দিতে পারবা? ধরে ওদের চালান দিয়ে দেব। থাকি না থাকি ওদের সাইজ করব আমি। তোমরা এলাকার বাইরে থেকে মাদক ব্যবসা করবে। কোনো সমস্যা নেই।

জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আতিকুর রেজা সরকার আতিকের সমালোচনা করে ওসি মাহবুবকে বলতে শোনা যায়, নির্বাচনের আগে শুভকে ধরতে পারব না। সব কথা  ভেঙে বলব না। কথা সব হয়ে গেল; যদি আতিকের বদলি চাও আরও দুই লাখ টাকা দাও। কালকেই আতিকের বদলি হয়ে যাবে।

ওসি মাহবুবকে আরও বলতে শোনা যায়, ৫ লাখ আর ২ লাখ মিলে মোট ৭ লাখ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করো। আতিক বাদ, ওই দুজনকে (মুক্তা ও শুভ) ট্যাকেল দেওয়ার দায়িত্ব আমার। নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর মন্ত্রীকে বলে ওই দুজনকে ধরে অ্যারেস্ট করে চালান করে দেব। আমার সব ওপরের লাইন। যে টাকা দিবা এই টাকাই ওপরে কাজ করবে।
অডিওতে গৃহবধূ সাহারা বেগমের ‘সুন্দর চেহারা’ নিয়েও মন্তব্য করতে শোনা যায় ওসিকে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাহারা বেগম বলেন, আমার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ ও র্যাবের সোর্স হিসাবে কাজ করেন। চারঘাট এলাকায় তার সোর্সের মাধ্যমে অনেক মাদক উদ্ধার করেছে র্যাব-পুলিশ। গত ইউপি নির্বাচনে তিনি সদস্যপদে ভোট করেন। এর পর থেকে এলাকার মুক্তা, শুভ ও সাব্বিরের সঙ্গে আমার স্বামীর বিরোধ বাধে। এর জের ধরে আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করায় তারা। ডিবিকে তারা ম্যানেজ করে। 

সাহারা আরও বলেন, চারঘাটের চামটা গ্রামের মুক্তা, শিবপুর গ্রামের সাব্বির ও শলুয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ শুভ আমার কাছে ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। একইসঙ্গে টাকা না দিলে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয়। সেই অভিযোগ করতে থানায় গেলে ওসি ৭ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করে আমাকে মাদকের ব্যবসা করতে বলে। তাতে আমি রাজি না হলে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয়।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি মাহবুবুল আলম বলেন, আমার কাছেও অডিওটা এসেছে। কিন্তু কীভাবে হয়েছে আমি জানি না। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। 

এদিকে ভুক্তভোগীরা আরও জানান, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, চারঘাট, বাঘাসহ কয়েকটি মাদকপ্রবণ এলাকায় জেলা ডিবির মাদকবিরোধী অভিযান নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ডিবি পুলিশ বড় মাদক কারবারিদের টাকা নিয়ে একদিকে যেমন মুক্ত পরিবেশে মাদক ব্যবসা করাচ্ছেন, তেমনি কারও কাছে টাকা না পেলেই ফিটিং মামলা দিয়ে গ্রেফতার করছেন। কোনো কোনো মাদক ব্যবসায়ীর কাছে নিয়মিত মাসোহারা নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে ডিবি পুলিশের বিরুদ্ধে।